Saturday, July 16, 2022

কবিতা || সুপ্রিয়া দত্ত




স্তম্ভিত বেলা

সুপ্রিয়া দত্ত (প্রহেলিকা)

 ঘরবন্দী গুচ্ছ গুচ্ছ বিষন্নতা ,
স্মৃতি আকড়ে যত দূর অতীতে যায় -
বর্তমান তালাবদ্ধ কুঠুরির কোনে গলা চেপে ধরে।
শহরতলীর ব্যস্ততম ঐ রাস্তাটা
আজ রাতের অন্ধকার জুড়ে শুধুই
শেষের খেয়ায় মৃত্যু বোয়ে চলেছে।
যেনো আকাশ জুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘুড়ি
কিন্তু একে একে সব ঘুড়ি ভোকাট্টা।
কোন অজানা কাটছে এই ঘুড়ি
রিলেশন করে দিচ্ছে ডিপ্রেশনের সাথে?
বোকাবাক্সের দিকে হাঁ করে বসা চোঁখ- নাক
যেনো গিলছে নিজেরই মৃত্যুর খবর।
লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী অথবা ছোটো ব্যবসায়ী
ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সংসার তাদের,
এ কোন অভিশপ্ততার হয়রানি!
তবে যে শকুন্তলাকে অভিশাপ দিয়েছিল দুর্বাসা
অথবা বাসরে কালনাগিনীর ছোবলে 
স্বামীকে হারিয়ে বেহুলার আর্তনাদ,
এ বিষ জ্বালা কি তার চেয়ে অধিক নয়?
মরণ তো এখন হাতের কাছেই,
বেঁচে থাকাটা সংশয়।




সুভাষ নগর
বনগাঁ
 উত্তর ২৪ পরগনা


Friday, July 15, 2022

কবিতা || দেবাশীষ চক্রবর্তী




দেখা

দেবাশীষ চক্রবর্তী

কোথায় যাব ? এইতো আছি এক্কেবারে কাছটি ঘেঁষে ,
তোমার রঙিন আঁচলখানা ছুঁচ্ছে আমায় মিষ্টি হেসে। 
কোথায় যাব ? এইতো আছি সামনাসামনি বোকার মতো ,
দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে আজ , পিঠে অনেক ছুরির ক্ষত। 
দেখতে আমায় পাচ্ছ না তো ? দৃষ্টি কি সব দেখতে পারে ?
চোখ কি দেখে যখন মানুষ নিজেই নিজের মনকে মারে !
কত শত লোক দেখ রোজ , তাদের কজন মনেই আসে ?
চোখ দিয়ে নয় , মনে দেখো , দেখবে আছি তোমার পাশে । 
তোমার কাছেই বসত আমার অপেক্ষা তো ডাকের শুধু ,
চোখ বুজে কি দেখছ আমায় ? যদি না পাও হৃদয় ধু ধু !


ইন্দিরালয়, ৮০. নরসিংহ দত্ত ঘাট রোড,
সুখচর, কলকাতা-৭০০১১৫



কবিতা || অভিষেক মিত্র




স্বাধীনতা

 অভিষেক মিত্র

আমি বিশ্বাস করি:

তুমি অদৃশ্য হয়ে যাওনি,

মরেও যাওনি।

শিশুদের ভয়ার্ত চোখে, কিম্বা

আমাদের নিচু করা মাথায়,

প্রতিটি ছুটে যাওয়া ট্রেনে,

আমি তোমায় দেখি।

তুমি, পাহাড়ের চুড়ার মত, অনড়,

সাগরের ঢেউের মত, অবিরাম তোমার উপস্থিতি।

মনে রেখো,

যে পাখি খাঁচায় জন্মেছে,

তার কাছে উড়ে বেরানোটা কিন্তু একটা অসুখ,

স্কিৎজোফেনিয়ার মত। 









ঠিকানা ১ – D-2, Flat No – 504, OCL New Colony, Rajgangpur, Orissa – 770017


কবিতা || সৌভিক ভান্ডারী




অমরাকাঙ্ক্ষা

সৌভিক ভান্ডারী

যদিও জীবন চলিয়াছে   
        ন্যায় নদীর স্রোতে ;           
অতীত থেকে চলে আসিয়াছি      
        আজ অনেকটাই দূরে ;
তবুও যেন পুরোনো কিছু স্বপ্ন   
      মনের দোড়গোড়ায় ছটফটিয়ে মরে ।। 


কর্তব্যের খাতিরে ভালোলাগা,খারাপলাগা       
   সমস্ত কিছুকেই যে রেখে দিতে হয় দূরে ;     
কিছু চাহিদা, কিছু ইচ্ছা আর কিছু আকাঙক্ষা                 
  যেন চলিয়াছে একান্ত জীবনকে খনন করে ।।


চাহিদা আর আকাঙ্ক্ষায় যে
    বাঁসা বেঁধেছে গোটা জীবন জুড়ে ;
এরাই তো দিয়েছে
     জীবনখাতাকে পূৰ্ণ করে ।।


কিছু স্বপ্ন স্বপ্নতেই থাকে
    ঘটেনা যে তাদের কোনো মৃত্যু ;
পাওয়া যায় না যে তাদের থেকে সন্তুতি
    এরাই হয়েছে একান্ত জীবনের একমাত্র সঙ্গি ।।                        
                             
                                     



সিউড়ি
বীরভূম

কবিতা || শঙ্কর ঘোষ




খুশির ঈদ

শঙ্কর ঘোষ

রমজান মাস শেষ হলেই আসে খুশির ঈদ,
ছোটদের ঈদের গল্প শোনায় চাচা রশিদ।
ইমাম ঈদ ঘোষণা করেন আকাশে চাঁদ দেখে,
ঈদে নতুন পোশাকে ঘোরে গায়েতে আতর মেখে।
ঈদের দিনেতে মসজিদে নামাজের ঢল নামে,
ঈদে প্রবাসীরা কাজ থেকে ফেরে নিজ নিজ ধামে।
ঈদের দিনে লোকজন এসে সবার বাড়ি ভরে,
নানা স্বাদের সেমাই পিঠে খাওয়ান তৈরি করে।
ছোটবড় সবাই নতুন পোশাকে বেড়ায় ঘুরে,
বাড়িতে আসেন কাজের সূত্রে থাকেন যারা দূরে।
খুশির ঈদকে কেউই চায়না করতে নষ্ট,
ঈদের দিনে দীন দুখিরা পায় যে বেশি কষ্ট।
ঈদের দিনে খাবার পোশাক করলে পরে দান,
তবে নামাজ পড়লে খুশিতে ভরে আল্লার প্রাণ।
সব মুসলমানেরা একহয় যে ঈদের দিনে,
সবাই যেন একহই হিংসা মারামারি বিনে।




উত্তর কালীনগর হাবসী পাড়া লেন
কৃষ্ণনগর
নদীয়া



কবিতা || বিউটি কর্মকার




সত্য স্বাধীনতা

বিউটি কর্মকার

তোকে অনেক কষ্টে পেয়েছিলাম আমরা।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্ন, আর অনেকখানি আশা-
যখন এলি আমাদের কোলে,
ভরিয়ে দিয়েছিলাম ভালোবাসা।
এ মাটির বুকে অনেক রক্ত লেগে আছে,
অনেকখানি বেদন!
সে রক্তের ভাষা তুই বুঝবিনা।
তুই তো রাজনীতির জামা পরে
হয়েছিস বড় আধুনিক।
ওরে স্বাধীনতা, তুই এখন
ভোট উৎসবের প্রতীক!
পরিচয় ভুলেছিস, ভুলেছিস পিতা মাতা,
মিথ্যাবচন, চটুল উৎসব তোর অন্নদাতা।
হায় রে স্বাধীনতা!
যদি কখনো মনে হয় একবার ফিরে যেতে,
খাদি চরকা, চরমপন্থা অপেক্ষা করে আছে।
শুধু একবার ফিরে আয় আমার সত্য স্বাধীনতা।
বিপ্লবের আঁখিজল, হবে না বিফল
আছে যে ভারতমাতা।




চরকডাঙ্গা, বারাসাত নতুনপুকুর রোড
উঃ 24 পরগনা
কলকাতা:700124




কবিতা || মুহা আকমল হোসেন




সম্পর্ক

মুহা আকমাল হোসেন 



তোর উপন্যাসের সম্পর্কটা বুঝি এইভাবে বাঁচে
পূর্বরাগ প্রথম প্রহর লেগে আছে আয়নার কাচে। 
রাঙা ভোরের যুগল দোয়েল ডাকছে কদম গাছে। 


এখনো তোর অভিসারী পা বড়ই শাসন ভাঙে 
সর্ম্পকের গোপন কলসি ভাসে যমুনা কিংবা গাঙে। 

তোরে গল্পের ধূসর অনুচ্ছেদে কানুর বাঁশি কানে 
বেহেস্ত ভেঙ্গে গন্দোম চাখে আদম -ইভ এইখানে ! 





ছোট সুজাপুর, 
মালদা-৭৩২২০৬ 



কবিতা || প্রশান্ত কুমার মণ্ডল




আমায় নিয়ে

প্রশান্ত কুমার মন্ডল

আমায় ভাবে রাগি ভীষণ
আমাকে ভাবে পাজি
সবার সাথে মিশতে গেলে
কেউ হয়না রাজি।

আমায় ভাবে চালাক ভারি
কথায় পটু বেশ
বিপদে পড়লে সবাই ডাকে
থাকে না রাগ দ্বেষ।

পড়া শোনাটা হয়না কভু
মাথাটা গোলমেলে
বাড়িতে কেউ বলেনা পড়্
বেড়াই খেলে খেলে।

পাড়ার কাজে আমাকে ডাকে
সবার আগে যাই
তবু ভাবনা আমিই বাজে
ভলো চিন্তা নাই।

আমার মা যে শহরে যায়
পরের বাড়ি কাজে
একলা আমি করবো কি যে
তাইতো বলে বাজে।



১নংদিঘীরপাড়,পো:ক্যানিং টাউন
দ-২৪পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ



সূচিপত্র ও প্রচ্ছদ




গল্প


কবিতা ১


ছড়া 


রম্যরচনা 


অনুগল্প


প্রবন্ধ


কবিতা ২


মুক্তগদ্য 



কবিতা || সৌরভ মান্না




ভাঙা আয়না 

সৌরভ মান্না 

ভাঙা আয়না। অবয়ব চেনা যায়না।
অচেনা অসুখ-বিসুখ,উড়ে গেছে সুখ। রাস্তায় হাঁটে বিকৃত যত মুখ।
ভোরের সিন্গ্ধ আলো,কে জানে কার গ্রাস হলো !
অদ্ভুতুড়ে ছায়া নামে গ্রাম হতে শহরে,অজস্র সংসার ভাসে মৃত্যু জোয়ারে।
শেষপ্রান্তে বসি বটের ছায়ার তলে। শ্মশানের ছাই উড়ে এসে গায়ে লাগে।
মৃদু হাসি ফোটে ফুল হয়ে ঠোঁটের কোণে,ভাবি এইবুঝি রাঙামুখে এলোচুলে তুমি এলে-
নিভে যায় হঠাৎ রবির কিরণ,শুরু হয় তীব্র বিষাদ চিত্তের বিচরণ
লাখ-লাখ-কোটি-কোটি ভাঙা আয়না ঘিরে ধরে,বিস্ফোরিত হয় বুক হৃদয় কম্পনে
আর,চেনা প্রিয় প্রতিকৃতিগুলো কি বীভৎস ঢঙে,প্রহসনের বিষ-জালে আমাকে বাঁধে। 




raynagar
amardaha
bagnan
howrah


কবিতা || শুভজিৎ দে




নিঃস্ব বলে কিছু হয় না 

শুভজিৎ দে 


এই বেশ একাকী আছি
কোনো গোপনীয়তা নেই
বিলাসিতার গল্প নেই
 
 রোঁস্তরা গর্ভগৃহ থেকে উল্লাস ভেসে আসে–
 তা আমায় ছুঁতে পারেনি কোনোদিন
 বরং,রাজার হিংস্রতার বিরুদ্ধে যে মৌন মিছিল
                                      হাঁটছে প্ল্যাকার্ড হাতে
তা বরাবরই আমায় টানে।

কিছু মানুষ বাক থাকতেও বাকহীন
                   দৃষ্টি থাকতেও দৃষ্টিহীন
প্রতিবাদ করতে সমর্থ হলেও–প্রতিবাদে বিমুখ
তারা চিরকাল নিঃস্ব, দুঃস্থ কিংবা সুবিধাভোগী 

আদতে নিঃস্ব বলে কিছু হয় না
যা কিছু হারিয়ে যাওয়ার ঠিক হারিয়ে যায়
শুধুমাত্র অন্তহীন সময়ের উপেক্ষা



সাধনপুর
পূর্ব বর্ধমান



কবিতা || একুশের সুকান্ত




দেবদাস

একুশের সুকান্ত

একুশের এই চরাচরে জেগে উঠলাম, দেখলাম আশপাশ, 
মনে হলো কিছু হারিয়েছি, খুঁজে দেখি সেটা বিশ্বাস।

চারিদিকে শুধু হাহাকার,ধর্মীয় ম্যাসেকার মূক-বধির সরকার, 
শিক্ষিত বেকারে ছড়াছড়ি,তাদের গোলামীর খুব দরকার।

পরিবেশ হাসফাঁস, উষ্ণায়নে উঠছে নাভি : শ্বাস,
ফুরিয়েছে জল, শুকিয়েছে ফল,লাটে উঠে চাষবাস।

তারপর হঠাৎ একটা শব্দ! একটা মিষ্টি ঝঙ্কার, নূপুরের টঙ্কার, একি আশ্চর্য! এটা বাস্তব? নাকি কোনো মায়াবী চমৎকার?

একে একে তারা নেমে এলো, কত পিপাসু মন ছিনিয়ে নিল, হাসলো,আদর করে কাছে টানলো, ফাঁকা স্থান পূর্ন করল, চিরসঙ্গী হওয়ার আশ্বাস দিল, কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যেই আলগা বাতাসে মিলিয়ে গেল ।

তারা খুঁজলো নতুন মন, পুরোনোটা ফেলে দিল ছুঁড়ে
ঠিক যেমন করে মরার পর আত্মা দেহ ছাড়ে, পুরাতন হল নিঃশেষ, যাযাবরের মত হল বেশ, শোক হল চিরন্তন।

আবার সেই হাসফাঁস, মিথ্যা হয়েছে আশ্বাস, অসহ্য মর্ত্যবাস, হারিয়ে গেছে বিশ্বাস, তবু শোক চিরন্তন আর প্রেম পিপাসু মানুষের পরিচয় আজও দেবদাস।




সম্পাদকীয়




     সময়ের সাথে হেঁটে চলতে চলতে আমরা আমাদের স্বরূপিনী পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যা প্রকাশ করার লগ্নে এসে পৌঁছেছি। সবটাই পাঠক ও লেখকদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। এবারের সংখ্যায় অসংখ্য লেখা পেয়ে আমরা সত্যিই আপ্লুত।

    আপনারা লেখা পড়ুন ও পরিচিত মানুষদের মধ্যে সবার লেখা ছড়িয়ে দিয়ে অন্যান্য লেখকদের অনুপ্রাণিত করুন।

   ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আর যেখানেই থাকুন সাহিত্যে থাকুন।


                                        ধন্যবাদান্তে
                                স্বরূপিনী পত্রিকা পরিবার




কবিতা || মলয় কোলে


অন্ন ছুঁতে 

মলয় কোলে

জানি ওরা সবাই ভেসে গেলো 
যারা ভরে দেখেছিল স্বপ্ন,
জানি ওরা সবাই মরে যাবে,
যাদের হয়নি হাতে হাত মেলানো,

ওদের চিৎকার শোনা যাবে জলে 
বাঁচার চেষ্টা ওরা প্রাণ ভরে করবে,
গলা পচা ওদের দেহ নষ্ট হবে খালি
জায়গা হবে না চিতায় বা কবরে,

উঠানে যারা করছিল সাঁতার খেলা,
যে শিশু টা আম্মি আম্মি বলে ডাকে,
ওদের খেলায় নবীন কিশোর ছোটে
নিয়মে ওরাও তো পড়েনি ফাঁকে,

খাবার জোটেনি কদিন ওই চারজনের,
যারা বেঁধে ছিল ঘর গাঁয়ের কোণে,
সকালে ওরাইতো এঁকেছিল ভবিষ্যৎ,
রোদেলা দিনে কেউ রাখেনি ওদের মনে

দুজন সঙ্গী যাদের বন্ধুর নাম ছিল লাঠি,
গল্প হয়নি শেষ রাখা ছিল পরের জনমে,
চোখের আদরে গিয়েছিল ওরা ঘুমিয়ে,
 কান্না ছাড়াই ওরা মরে ছিলো প্রথমে,

 এসেছে কজন মানুষ বড় বড় ব্যাগ হাতে
এখন বোধহয় মরিনি সবাই আছে কজন বেচেঁ,
গলার খিদে পায়নি সবার আছে সেটা ভিজে,
ওদের খিদে পেটে চায় ওরা একটু অন্ন ছুঁতে।





কবিতা || রঞ্জন চক্রবর্ত্তী




আবদ্ধ দিনগুলি

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

 

অন্তহীন জীবনের খোলা খাতা থেকে
হাতে গোণা কয়েকটি প্রহর বাদেই
আর একটি নিয়মে আবদ্ধ দিন খসে যাবে
সীমাহীন নীরবতার কৃষ্ণ গহ্বরে,
ক্যালেণ্ডারের পাতায় লাল-কালো তারিখ বদলাবে –
অতঃপর একান্তে অতীতচারিতা . . .

 

কোন এক স্বগত সায়াহ্নে
একাকার হয়ে যাবে
 আমার বিষণ্ণ ত্রিকাল


কোনও পরিচিত মুখ থাকবে না কোথাও
শুধু আমার চিরচেনা আমি . . .  


আমার অস্তিত্ব জেগে থাকে বোধে ও বোধিতে






2/1A, Kalidas Lahiri Lane
Baranagore, 
Kolkata-700036

কবিতা || অভিষেক মণ্ডল




আমাকেই ভালোবাসো

অভিষেক মণ্ডল

পথের ধারে বসে কাটে
দিন তোমারি অপেক্ষায়,
তুমি বলেছিলে আসবে
ফিরে মোর আঙিনায়।

ঘরে এল শুধু নিথর দেহটা
কফিনে বন্দি হয়ে,
ছল ছল দুটি চোখ দিয়ে
রইলাম শুধু চেয়ে।

তেরাঙ্গা পতাকা বুকে
নিয়ে 'শহীদ' হলে তুমি,
আজ ও তোমার ফেরার
তরে দিন গুনছি আমি।hi

রাতের শেষে শুকতারা
হয়ে একটি বার আসো,
চোখের জল মুছিয়ে বলো
আমাকেই ভালোবাসো।





       গ্রাম+পোস্ট :- বড়গাছিয়া।
       থানা :- জগৎবল্লভপুর।
        জেলা :- হাওড়া।
        পিনকোড :- ৭১১৪০৪।



কবিতা || ঝুম্পা কবিরাজ




আশা

ঝুম্পা কবিরাজ 

অনাহুতের মতো বাক্য ব্যয় করি
প্রকাশ্যে-গোপনে কত শত বার
তবু বুঝি থেকে যায় জমা
ফুরায়না আলোচনা এ-বেলা আর।

আসন্ন শঙ্কাকে নিয়ে করি অভিযোগ
সময়ের স্রোতে মোরা ভাসি চিরকাল
আঁধারের ঘনঘটা খুঁড়ে দেয় ক্ষত
জানি তবু দেবে দেখা নতুন সকাল।

চিরন্তনের মিথ্যুক সাজে ধাঁধায় মন
রোষনায় ভুলে যায় ক্রমশই আপনারে
তবু চোখ বাসা বাঁধে আবার
অন্তরা গায় বসে সেতারের ভিড়ে।

দিন শেষে অস্ত যাওয়া জীবনে
রঙিন বসন্তের স্মৃতি ঝলমলিয়ে ওঠে
অজানা কোনো এক আশায় যেমন
ঝরে পড়বে জেনেও ফুলেরা ফোটে।।



Madpur
paschim Medinipur
Kharagpur(local)




কবিতা || বিপত্তারণ মিশ্র




সব পেতে শব সাধনা
 
বিপত্তারণ মিশ্র 

সব পেলে শুধু জীবন নষ্টই নয়।
পরিবার নষ্ট, সমাজ নষ্ট। 
রাজ্যপাট ছাতা প'ড়ে ছ্যা ছ্যা।
রাজা, মণ্ত্রী, সিপাই, সান্ত্রী সব পচে অ্যা!
দল পচে দলা দলা দুর্গন্ধ 
সবাইকে দলে পায় যদি। 

ওইধারে কেউ নাই আর,
অন্ধকারে সবাই গুপ্তধন খোঁজে, 
আলো জ্বালাবে কেউ নেই কোথাও। 
সব পেতে শব সাধনায়
সবকিছু নষ্ট আমূল!




Green Park, Saraitikar Road, Amtala 
Burdwan, PO-Rajbati, PIN-713104



কবিতা || করবী দাস




কাল দিনটা অধরা

করবী দাস

আজ সকালে যদি তোমার কথা ভাবি
             তোমার অপেক্ষাতে বসি
মনে হয়, আজ বুঝি তুমি এলে।
         মনে মনে মূহুর্ত গুনি-
                          নিজেকে পলকে পলকে সাজাই,
        হৃদয়ে আনন্দ ছোটে,
                             এটা করতে ওটা করি
                   কত কাজেই না ভুল হয়।
      দরজার পাশে মাধবীলতাটা আনন্দে দোলে
      তার থোকা খানা যদি
                                 হাতের কোলে ধরি
           সে যেন আনন্দে রঙিন হয়ে বলে,
                             "আজ তুমি আসবে"।
        হাওয়ায় হাওয়ায় চুলগুলো
                               হয়ে পড়ে বাঁধনহারা
              সামলাতে গিয়েও হাতছাড়া হয়
        সেগুলো বলে, 'আজ না হয় নাই বা বাঁধলে'।
         আপনমনে যদি দূরে তাকাই
                          আঁচলটা হয় নিয়ণ্ত্রণহীন;
                    দৃষ্টি অসীম পেরিয়ে-
                                জানি না, কোথায় কার অপেক্ষায় থাকে,
                 মন বলে, 'আজ তুমি আসবে'।

           সারাদিন পেরিয়ে যখন
                              তুমি এলে না,
               নিঃশ্চুপ হয়ে বসে পড়ি গালে হাত রেখে-
           তখন দূরে থাকে না দৃষ্টি
                            অসীম থেকে মাটির বুকে আছড়ায়।
           আর কিছু ভাবি না-
                              মন শুধু বলে,
                                       'আজও তুমি এলে না'।
               চুলগুলো থাকে তেমনি ছাড়া
               বাতাস এসে ঠেলা মেরে ওড়ায়,
               আঁচলটা হয়ে ওঠে সংযত।
           মাধবীলতাগুলো যেন
                                     মাথা হেঁট করে রাখে;
            মন আবার নিরাশ হয়ে ঘরে ফেরে-
                   আবার শুরু হয়,
                                  তুমি ছাড়া শূন্য জীবন
                              মন হারানো নিঃস্ব একাকীত্ব
                                      অন্ধকার রাত্রীর মতো।

কালো আঁধারে রাত্রীর সাথে
                           নিজেকে মিলিয়ে
                  বালিশে মুখ গুঁজে
                                     কাঁদতে কাঁদতে শ্রান্ত হয়ে আসি-
                  
                   মন বলে,
                               আজ আসনি কাল আসবে,
                   আমি তো কোনো হৃদয়হীনকে ভালোবাসিনি।
                  
                 আবার বসে থাকি আশায়
                                  সকাল থেকে আবার সাজে মন
                           চুল ওড়ে, মাধবীলতা দোলে-
                           আবার বলে, 'তুমি আসবে',
                           আবার কাজে ভুল হয়।
বিকেলে আবার নিঃশ্চুপ হয়ে পড়ি,
                   দৃষ্টি চুমু খায় অসীম থেকে মাটির বুক
              আবার চুলে বাতাস ঠেলা মারে,
                               মাধবী মাথা হেঁট করে;
           আবার রাতে বিছানায় একা কাঁদি-
                                    বালিশ ভেজে,
                    আবার শ্রান্ত হই-
  আবার ভাবি, তুমি হৃদয়হীন নও
                           কাল আসবে-।
                                   দিন কেটে যায়,
               কাল দিনটা অধরাই থেকে যায় জীবন।

                                 

                                    
চক, পীতাম্বর দত্ত, শিবগঞ্জ, বাসন্তী,
 দক্ষিণ ২৪ পরগণা, ৭৪৩৩১২।
                              ফোন নাম্বার :9674273234




কবিতা || অবিনাশ দাশ



পড়ন্ত হাওয়া

অবিনাশ দাশ


তোমার চেনা ছায়াগুলিতে
আজও অমর সৌন্দর্যের মায়া দোলে।
পলাশের গন্ধ মাখা লাল মাটি,
পাখিদের কলতানে মিশে আছো।
এলোমেলো চুলে সুগন্ধির রেশ-
জানালার গরাদ ধরে আনমনা তুমি!
পূর্ণিমার চাঁদ মেঘেদের দলে হাসে,
অশ্রু-হাস্যে সুর বাঁধি আমি!

কাতর আকাঙ্খায় দিন যায়।
বিপুলা পৃথিবী ক্লান্ত সে ভীষণ! 
বারান্দার ছোট্ট কোনে উদাস আমি
রাত্রি - আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছি প্রতীক্ষায়।
তুমি কি দেখেছো আমায়?
সেই আমি! অস্থির বিধ্বস্ত আমি!

----------------------------


গ্রাম - রঙ্গণবেড়িয়া, পোঃ মহেশপুর,
 থানা -মগরাহাট
জেলা- দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পিন - ৭৪৩৩৫৫, 





কবিতা || প্রবোধ চন্দ্র দাস




কবিতা

প্রবোধ চন্দ্র দাস 

কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা,
    নাকি কোন অবাক করা লীলা
শুধু কি সুবিন্যাসে বিস্তার করা ?
    যেমন মনে হয়, কোন বাস্তব খেলা।

এতো এক কল্পনা প্রসূত ব্যাপার
    কবির সন্তান বা মানস পুঁতুল,
যেমন বলবে তাই যেন করবে
    আশ্চর্য, মনের কথা করে না ভন্ডুল।

অবিকল মানুষের মতো কাজ
    কতো হাঁসি, কান্না, সুখ, বেদনা,
সবই অন্তর্নিহিত, তবে পড়তে হবে
    তাহলেই করা যাবে বিচার বিবেচনা।

কবিতা তো কোন নোট বুক নয়
    যে পয়েন্টগুলো নোট করে রাখবে,
কবিতা পড়া যায়, গবেষণাও করা যায়
  অণু-পরমাণু জুড়ে মৌলিক করে লিখবে ॥
                         ———


৩২, ড: বীরেশ গুহ স্ট্রীট, দ্বিতীয় তল,
পো. অ - সার্কাস এভিনিউ,
কোলকাতা- ৭০০০১৭



কবিতা || মহুয়া দাস




লড়াই 

মহুয়া দাস

জানালার গড়াদে ঝুলছে এক পোকা
মৃত্যু কে উপেক্ষা করে লড়ে চলেছে। স্পন্দন ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। পাখার ছটফটানি...

আষাঢ়ে বর্ষায় মেঘাচ্ছন আকাশ ভীষণ ভালো লাগা, অস্ফুট স্বরে জানান দিচ্ছে তার মৃত্যু কে।

বাঁচতে চাওয়া কি অপরাধ? সগোটুক্তি
ক্ষীন আশা নিয়ে তোলপাড় চলছে অবিরত যেন, প্রকৃতি বিপর্যয়ের ডাক পড়েছে ... শান্ত করো মন,
‍ওঁম শান্তি ওঁম শান্তি ওঁম শান্তি।

জানালার গড়াদের ফাঁকে ঝুল হয়েছে
চুম্বকের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মরে গেছে পোকাটি।
সারি সারি পিপীলিকা উৎসবে মেতেছে
সাজো সাজো রব জ্যোৎস্না রাতে মেঘের আড়ালে একফালি চাঁদের খেলা,
চাঁদনি রাতে আমার প্রিয়া আসবে বলে কত আয়োজন।

বাঁচতে চাওয়ার আকুলতা পাখার ঝাপটায়
নীরব হয়ে পড়ে রইল মৃত্যু উপেক্ষিত জীবটি।
পৃথিবী তার গতি পথে নীরবে নিরুত্তর
থমকে থাকে না সময়, থাকে না মহাকাল।

থাকে শুধু নিশ্চিন্ত অঝোর কান্না। ব্যথা পায় না কারণ প্রাণহীন প্রাণের নেই কোনো চেতনা।জানালার গড়াদে ঝুলছিল এক বিচিত্র পোকা।
                  ----------------------




Kalyani, Nadia




কবিতা || অম্বর মন্ডল




গুচ্ছ কবিতা

অম্বর মন্ডল

রবীন্দ্রনাথ
  
এসো হে মহাপুরুষ,কেনো আছো লুকিয়ে
কেনো লেখো কবিতা ঝাকিঁয়ে।
নাম হলো রবীন্দ্রনাথ
আমরা সবাই আদর করে ডাকি যে রবি।
তোমার কবিতায় আছে যে ছন্দ
কোথায় হরিয়ে যায় মনের ও গন্ধ।           
কেনো চলে গেলে আমাদের ছেড়ে
কেনো তুমি নিয়ে গেলে সুখ সাচ্ছন্ধ‍্য কেড়ে।
কেনো আমরা হারালাম যুদ্ধ পরে
ফিরে এসো,এসো তুমি মহাপুরুষ রে।
কবিতায় তোমার মন জড়ানো
কত কষ্ট কবি হারানো।।



শরৎকাল

শরতের আবহাওয়া বড়ো মনোরম
মেঘ আকাশে ভেসে বেড়ায় আনন্দনয় কম।
শরৎকালে ফোটে হরেক রকম ফুল
ঘর ঝারাঝারি থাকে না ঝুল।
শরৎকাল মানে খুশির আবদার
জামা কাপড় বোমবাজি দেয় উপহার।
শরৎকালে বাঙালীরা ভাবে সব
এবার আসছে এবার আসছে মায়ের উৎসব।
 এবার আসছে এমন পূজা যা সরবোজনীন
সেই পূজোকে আমরা দূরগা পূজা বলে মানি।



ছুটি

ছুটি ছুটি গরম রুটি
বাড়িতে বসে কূটনো কাটি।
হাতে আছে শিল নোড়া
খেলতে এসেছে আমার বন্ধু যে বানায় খুব ভালো ছড়া।
গ্ৰীষ্মকালে ছুটীতে প্রচন্ড খুব কড়া
ছুটিতে মা রেগে গেছে,বলছে হবে নাকো লেখাপড়া।
দুপুর বেলায় খেলতে মানা বিকেল বেলায় যাও
রোদে তখন মাথা ঘুরবে সেটা কি তুমি চাও।
ছুটি মানে হল না পড়া পরীক্ষার চাপ
পরীক্ষায় কম নম্বর মা বলল বাপরে বাপ।।




পাখি

পাখি পাখি
তোমায় ডাকি,
খেলবে দিনে আমার সাথে
কাজ করব আমি রাতে।
চিন্তা কেন করছো ভাই
একসঙ্গে খেলবো সবাই।
এত কিসের তোমার লাজ
হবে তোমার সব কাজ।
খাবে দানা একটি দুটি
সঙ্গে দেব মিষ্টি রুটি।
সঙ্গে খাবে গাছের আম
দেব পেড়ে মিষ্টি জাম।



কবিতা || পূর্বালী দে



ভাবনা

পূর্বালী দে

অচল প্রেম, বন্ধন ছিন্ন,
এচোখ একা, শব্দ ভিন্ন।
ভুল রঙে, অবৈধ দাবি,
গভীর রাতে,আছাড় খাবি।

শীর্ষে রাখো, সোহাগ ঘোরে,
অনন্ত আকাশ, মেঘে মোড়ে।
শব্দ স্রোতে, নদী হবো,
মিলন তীর্থে, মুক্তি পাবো।

যে দুটো‌ দিক , এমনি খোলা,
ভুল যাপনের, ছন্দ দোলা।
ধূসর জগত , ভাবনার জন্ম,
অহেতুক কৌতুক, ওটাই কম্ম।।



২৪, কেদারনাথ দেউটি লেন কদমতলা হাওড়া 711101



কবিতা || নীলেশ নন্দী





বর্ষাকালের কবিতা

নীলেশ নন্দী

আকাশে জমেছে কালো মেঘ,
মুহুর্তে বেড়েছে বায়ুবেগ,
ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি
ব্যাঙগুলো সব ডাকছে মিষ্টি,
পুকুরের জল থৈ থৈ
লাফ দিচ্ছে শিঙি-কই,
রাস্তা দিয়ে বাচ্চা ছেলে
যাচ্ছে মাথায় ছাতা মেলে,
ভেসে যাচ্ছে রাস্তাঘাট,
জলে ডুবছে খেলার মাঠ;
এসব আমি দেখছি শুধু
লিখেও রাখছি একটু একটু,
একদিন সব বলব আমি
চুপটি করে শুনবে তুমি।



মধ্যমগ্রাম; কলকাতা: ৭০০ ১৩০।



কবিতা || সৌমিত্র উপাধ্যায়





জড়ত্বের স্বীকৃতি

সৌমিত্র উপাধ্যায় 


সেই গভীর স্তব্ধতা
কখনও বোঝোনি তুমি 
আমার পথের শেষে দূরে 
দেখা যায় নীল নির্জন মরু

মিলেছে পথের কাঁটা 
বিষাদের টানে অভিমানী 
দিবারাত্রি খুঁজেছি জলের দুর্বলতা 

কতটা গভীর না জেনেই মাতামাতি  
সুখ নেই মানি 
শুধু পাত্রভরা দুঃখের আকৃতি 

বালি ওঠে নীরব সংস্কারে 
ঘেঁটে যাওয়া কাদাজল 
বুকে টেনে নিয়েছি প্রবল 

অর্ধেক জীবন 
বয়ে নিয়ে গেছে করাল বৈশাখ 
আর কিছু না হোক 
বাকি অর্ধেক জড়ত্বের স্বীকৃতি পাক..

---------




Ashiyana Society, Flat No.2C,
Phase-2,Shankarpur, PO : Arrah
Durgapur - 713212
Paschim Bardhhaman




কবিতা || মোহিত ব্যাপারী




একলা হওয়ায় 

মোহিত ব্যাপারী 


শাওন বেলায় উদাসী হাওয়ায়, 
একলা প্রহর নিঃসঙ্গতায় ভেসে যায়। 
অরুণ আলোর অস্তাচলের বেলায়, 
বেদনার সুর ভেসে যায় অজানায়। 
জুঁই মল্লিকা হাসনুহেনায় গন্ধ ছড়ায়, 
বাতাস বয়ে আনে তার বারতা। 
ফুলের সুবাসে আবেশে ভেসে মন, 
উড়ে যায় ভেসে যায় নীল দিগন্তে। 
মেঘেদের ভিড়ে খুঁজে বেড়ায়, একলা হাওয়ায়
হারিয়ে যাওয়া সেই গানের সুর। 
ফুলেরা গন্ধ বিলায় অকৃপন শহরময়, 
কুলহারা এক কুলের ঠিকানায়। 
ফুলের সৌরভ যখন একমাত্র বন্ধু হয়। 
তুই চাস আর নাইবা চাস, 
জীবন বেঁচে থাকে শুধু 
তোর সুবাসের আলিঙ্গন সুধায়। 




NORTH 24 PARGANAS
                  



কবিতা || দীপঙ্কর সরকার






রাতের ঠিকানা 

দীপঙ্কর সরকার

নির্জনতা ভেঙে পড়ে রাতের ঠিকানা হাতছানি 
দ্যায় , ডুবে যাই আলোর গভীরে । উদাস উদাস
চোখে চেয়ে দেখি চাঁদের স্নিগ্ধতা ‌‌। মায়াময় এই
রাত হিমেল হাওয়া মাখা । ফুটি ফুটি করে যেন
কোরক সমূহ , একটি দুটি পাপড়ি মেলে দ্যায় ডানা
সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ইতস্তত নিষেধ মানে না কোনো
নদী স্রোত বয়ে যায় নিরবধি ভাঙে পাড় ভাঙে
নির্জনতা রাত জানে রাতের ঠিকানা ।




চাকদহ
নদীয়া




কবিতা || শুভদীপ দত্ত প্রামানিক




সৌরকণিকা

শুভদীপ দত্ত প্রামানিক 

জলে ধ্যানস্থ কমলা পিতা
তারায় তারায় ক্লান্ত পূর্বপুরুষের অসহায়তা
অস্থির , তাও সৌরকণিকা আমার জপমালা
বৃহত্তর শূন্যে আমি কণা অধিক কণা । 

কেউ দেখেনি উল্কার চঞ্চলতা
পাখনার নীচে ঠুঁটো কালো কাকের কামমন্ত্র
অবশেষ নেই , সুদ নেংটি অনুভব
শুরুও নেই , আসল চারদিকে নাচে । 

নিঃসীম গ্রহে কে বাজায় আত্মপিপাসা
আমি কীট , আমি বিকুলি নক্ষত্র ছেঁড়া টুপি আমার নেই ! 




কীর্ণাহার 
 বীরভূম, নানুর




কবিতা || হামিদুল ইসলাম




গুচ্ছ কবিতা 

হামিদুল ইসলাম

নষ্ট চাঁদে গা ভাসাই 
শাদা ফুল শাদা ভাত 
শাদা ছাতার তলায় আমরা পাই না আশ্রয় ।।

কারা আসে কারা যায়
ফিরে আসে মরশুম 
বিপন্ন আলোর স্রোতে হাত বাড়াই। ডুবে যায় নির্জন দুপুর ।।

বানের জল বাড়ে 
বাড়ে না জীবনের দাম 
দুর্মূল‍্য বাজারে নাজেহাল ক্ষুধা। কখনো কোভিড নাইনটিন ।।

রাজপথে মিছিল 
সংগ্রামী প্রতিবাদ 
সুইজের সংসারে হাজার জনতা। সবার হাতে হাত গুচ্ছ কবিতা ।।




কুমারগঞ্জ
দক্ষিণ দিনাজপুর





কবিতা || সোমনাথ সাহা




তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি

সোমনাথ সাহা 

"যে জীবন ক্ষয়ময়, নশ্বরতা আবিশ্বসংসারে,
যে জীবন ভোগে লিপ্ত, যে জীবনে আসক্তি দুর্বার,
যে জীবনে আমি নই প্রকৃতার্থে অধীন আমার,
সে জীবন হীন বড়ো, নয় ঋদ্ধ মহত্ত্বসম্ভারে।"
                                  বুদ্ধচরিতম্ ( বন্ধনা )



হে মৈত্রেয়নাথ বুদ্ধ ! তুমি কি জানো কত তীর্থে তীর্থে উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি শুধু তোমায় ছোঁবো বলে।
আমার দরবিগলিত অশ্রুরাশি দিয়ে তোমার উপাসনা করেছি শুধু তোমায় পাবো বলে।
তুমিই সেই যে আমার জন্মজন্মান্তরের সঙ্গী।
আমার সকল বেদনার ভিতরেও তুমি;
আমার সকল আনন্দের ভিতরেও তুমি;
আমার জন্ম-মৃত্যু- হর্ষের- তপস্যায় তুমিই জলবিন্দু হয়ে ঝরে পড়েছ।
বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা আমি অমৃত যন্ত্রনায় পান করেছি শুধুমাত্র তোমায় ছোঁবো বলে।
আমি তোমার দাসের দাস, রেনুর রেনু ;
তুমি ব্রহ্ম হতে শক্তি , তুমিই তো বিরাট হতে স্বরাট।
যারা অজ্ঞান তারা বলে ঈশ্বর সেথায়-সেথায়,
যারা জ্ঞানী তারাই জানে ঈশ্বর হেথায়-হেথায়।
অন্ধকার এসে দাঁড়ালে আমি তোমার কাছে ফিরে যেতাম বারে বারে।
তখন তুমি আমায় শিখিয়ে ছিলে সূর্য হতে গেলে আগে নিজেকে জ্বালিয়ে দিতে।
তুমিই বলেছিলে যন্ত্রণা থেকে যে জ্যোতি প্রকাশ পায় তা দিয়ে জগৎ কে আলো দিতে।
সবশেষে তুমি যখন অনাথের বেশে ভগবান সেজে
আমার পাশে দাঁড়ালে,
তোমার দুহাতে আমার জীবনব্যাপী নৈবেদ্য তুলে দিলাম, তবুও তোমায় ছুঁতে আমি পারলাম না।
    
                      সমাপ্ত




উত্তর দুরগানগর, কলকাতা-৭০০০৬৫, রবীন্দ্রনগর, উত্তর ২৪ পরগনা।



কবিতা || পূজা পাত্র




একাকী প্রেত

পূজা পাত্র 


মাঝ রাতে বহু বার হাতরে হাতরে
আমি তোমাকে পড়তে চেয়েছি
অনেক টা কবিতার মত
বুঝিনি সত্যিই। এক এক বার
এক এক রকম অচেনা হয়ে দাঁড়িয়ে পড় সামনে
তবু বারবার আমি পড়েছি, তুমি বদলেছ
আজ আর আমি পড়ব না।
এবার আমি লিখব
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে
সাপ ব্যাঙ লিখব।
জোনাকির মত উপরে পাখার ব্লেডের কাছে উঠে যাব, 
জানি তো অমরার মৃত্যু নেই
প্রেত হয়ে ঘুরঘুর করব তোমার ছাতিতে।





 বৈদ্যবাটি, হুগলি


অনুগল্প || বিক্রমজিৎ চট্টোপাধ্যায়



অর্থহীন

বিক্রমজিৎ চট্টোপাধ্যায়


গতকাল রবিবারের পর আজ আরেকটা ছুটি। এরকম ছুটির দিন হলেই মনটা খারাপ থাকে মনোহারি মন্টু হকারের। অন্য দিনের তুলনায় ছুটির দিনে বিক্রিবাটা অনেকটাই কম হয়।একটা ট্রেন থেকে নেমে সে স্টেশনের কল থেকে বেশ করে জল খেয়ে নিল। তার পর আবার একটা ট্রেনের অপেক্ষা। ছুটির দিনে অনেক ট্রেন বাতিল থাকে। এরই মাঝে একটা ট্রেন আসার কথা ঘোষণা হচ্ছে। কিন্তু সেই সংবাদ চাপা পড়ে যাচ্ছে অদূরের ক্লাব ঘর থেকে ভেসে আসা গানের সুরে। মন্টু বিরক্ত হয়ে একবার সেই শব্দের অভিমুখে তাকাল। সামনের খালি মাঠটাতে বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ গড়ে ওঠা ক্লাব ঘরের সামনে তখন মাথা উঁচিয়ে স্বাধীনতা দিবসের পতাকাটা অনেকটা মন্টুর মনের মতই অস্হির হয়ে দুলছে। কেউ কোথাও নেই তবু উৎসব প্রকাশের উপলক্ষ্যে একটার পর একটা দেশাত্ববোধক গান বেজেই চলেছে।
            মন্টুর ভুরুটা একটু কুঁচকে যায়, সে তখন একাগ্র ভাবে শুনতে চেষ্টা করে,কোন ট্রেনটা আসছে।




৩৬/১, ওল্ড নিমতা রোড, বেলঘরিয়া, 
কলিকাতা - ৫৬।


অনুগল্প || কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)





ফুলেশ্বরী স্মৃতি স্টেডিয়াম

কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক) 


             "শোন ডাবু, বাবাদের কথায় রাগ করতে নেই।"
              "রাগ করব না তো কি গালে চুমু খাব?"
              "আহ! রেগে যাচ্ছিস কেন ? বাবারা ঐ রকমই। সন্তানের ভালর জন্যে অনেক কিছুই বলে থাকেন।"
             "তাবলে এইভাবে? জানিস ফুলু, সবার সামনে আমাকে অপমান করল আজ। আমার কোন আত্মসন্মান নেই?"
             "আত্মসন্মানে যখন এতটাই লেগেছে, তাহলে বাবাকে প্রমাণ করে দেখিয়ে দে যে, তুইও এই অপমানের যোগ্য জবাব দিতে জানিস।"
            "মানে?"
             "মানেটা ভীষণ পরিষ্কার। তুই বাবাকে দেখিয়ে দে যে, তুইও আজ থেকে স্বাধীন। মানে উনাদের মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচতে তুই শিখিস নি। নিজের পরিশ্রমে, রোজগারে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাস।"
         "কথাটা মন্দ বলিস নি। তা কিভাবে হবে শুনি?""
         "তোকে আজ থেকে বাবার প্রতি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে, স্বচেষ্টায় স্বাধীনভাবে রোজগার করা শিখতে হবে।"
          "রোজগার? আজ থেকে?"
          "হ্যাঁ, আজ থেকে।"
          "কাজটা বেশ কঠিন রে।"
          "ন্যাকা ফুসু! চুপ কর। অনেক হয়েছে। আমাকে ভালবাসিস যখন, তখন বিয়ে করে তো আমাকে খাওয়াবি না কি?"
          "হ্যাঁ, তা তো খাওয়াতে হবে। সেটা কিভাবে হবে?"
           "ও রে গাধা! তোকে বোঝানো যাবে না। এক কাজ কর, বিকেলে পুকুরপাড়ে আয়। সব বুঝিয়ে দেব।"

           ফুলুর কথা শুনে ডাবু বেশ লজ্জা পেয়েছে বলে মনে হল। তবে কথাটা বেশ মনে ধরেছে। 

             ফুলু, ডাবু দুজনেই এবার বারো ক্লাস পাশ করেছে। ফুলু ছোট থেকেই স্বাধীন। স্বনির্ভর। লোকের বাড়ি কাজ করে।মায়ের সাথে হাত লাগায়। বাবা মারা যাবার পর থেকে নিজেও আয় করতে শিখে ভাইদের টানছে।

          ডাবুর বাবা হকারি করে। তেমন আয় করে না। কোন রকমে চলে। সংসারে অভাব আছে।

             উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করে পাশ করতেই ডাবুর বাবা বলেই দেয়, ডাবুর এবার থেকে পড়ার সব খরচ ওকে নিজেকে ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া ওকে এখন থেকে রোজগার করতে হবে। বাবার উপর ভরসা না করে যেন চলে। এক কথায় বাবার অধীন যেন সে না থাকে। 

          তাতেই ডাবুর মটকা গেছে গরম হয়ে। পুকুরপাড় থেকে ফিরে এসে কিছুটা মনের জোর পেয়েছে। ফুলঝুরি কিছু বুদ্ধি বাতলেছে।

           আজ স্বাধীনতা দিবস। কলেজ মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে। দূর থেকে দেশাত্মবোধক গান ভেসে আসছে.....

           "মুক্তির মন্দির সোপানতলে.......
    ........লেখা আছে......
কত বিপ্লবী বন্ধুর.......
....... ........ ........ "       

 ডাবলু মাঠে রুটি, ঘুগনী, ডিমটোস্টের স্টল দিয়েছে। সকাল থেকেই দোকানে কাস্টমারের ভিড় উপচে পড়ছে। ওর দম ফেলার একদম সময় নেই। ব্যবসার কিছু টাকা ফুলঝুরি দিয়েছে ধার হিসেবে।

            সন্ধ্যের পর ডাবলু ছলছল চোখে গুণে দেখল সে আজ সাতশ টাকা আয় করেছে। জীবনের প্রথম রোজগার। স্বাদই আলাদা। মনটা তাই একটু ফুরফুরে। নিজেকে পর নির্ভরশীল আর ভাবছে না। সবটাই ফুলঝুরির ক্রেডিট। 

            বাইরে মাইকে নজরুলের কবিতা পাঠ হচ্ছে আর ডাবলুর বুকের ভিসুভিয়াস যেন লাভা উদগীরণ করে চলেছে......... .......।

             "বল বীর 
               চির উন্নত মম শির....
                 ........... হিমাদ্রির......"

            শির উঁচু করে ডাবলু ফুলঝুরির ঘরে ঢুকল। এক হাতে চিকেন চাওমিনের প্যাকেট। অন্য হাতে তেরাঙ্গা। 

          ফুলঝুরির জ্বর। অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ডাবলুর চোখে বেয়ে নামছে শ্রাবণ পূর্ণিমার ভরা কোটাল। । চাওয়ের প্যাকেট রেখে ওর মাথাতে পরম মমতায়, আদরে হাত বোলাল।

          ********* ***********

             দেখতে দেখতে ছাব্বিশটা পনেরোই আগষ্ট কেটেছে.....

              আজ আবার স্বাধীনতা দিবস।

             দেবানুজ রায় আজ মস্ত বড় বিজনেসম্যান। ওর আণ্ডারে প্রচুর লোক কাজ করছে। সবাই সৎ, স্বাধীনভাবে উপার্জন করছে। মাথা উঁচু করে।
 
              কলেজ মাঠে আজ একটা স্টেডিয়াম উদ্বোধন করতে এসেছে। স্টেডিয়ামের নামটাও বেশ ঝলমলে, "ফুলেশ্বরী স্মৃতি স্টেডিয়াম"।

              ফুলু মানে ফুলেশ্বরী নার্ভের জটিল রোগে বহু দিন আগে মারা গেছে। তবু ভালবাসা বেঁচে আছে। স্বাধীনভাবে।

             এই মাঠ থেকেই স্বাধীনভাবে পথ চলা শুরু করেছিল। সেই মাঠকেই নিজের ভালবাসার আদরে ভরিয়ে দিল ডাবলু ।

             দেবানুজের চোখে শরতের শিশির পশ্চিমীঝঞ্ঝার মেঘ হয়ে জমছে। নামছে দু গাল বেয়ে।

          মাইকে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে নজরুলের "বিদ্রোহী " কবিতাটি.....

      ".......আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত 
       ......বেদুইন......"





Address: 85, Kalibari Road, Nalta
                 Near Air Port Auto Stand
                 PO: Italgachha
                  Kolkata -28
                  North 24 Parganas


অনুগল্প || সব্যসাচী হালদার




অশ্রুর গর্ব 

সব্যসাচী হালদার

১৬ই জৈষ্ঠ, সময় বলতে গেলে প্রায় সকাল দশটা । সারা পাড়া ,না না বলতে গেলে সারা গ্রামটা যেন কোনো একটা বিশেষ কারণে ব্যস্ত হয়ে আছে। শুধু মাত্র একজন নিজেকে এই ব্যস্ততার থেকে আড়ালে রেখে প্রতিদিনের মতো হেঁসেল সামলাচ্ছে। হ্যাঁ রহিতের মা শ্রীমতী ছায়াদেবী । রহিতও খুব ব্যস্ত, ঠিক করে বলতে গেলে চিন্তিত, কারণ আজ যে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে। এই সকাল দশটার দিকে বেরোবে বলে খবর পেয়েছে সে।

সকাল থেকেই বন্ধুর বাড়িতে এসে বসে আছে রহিত নিজের রেজাল্ট, রিক-এর ফোনে দেখবে বলে। রিক আর রহিত ছোটো থেকেই খুব ভালো বন্ধু। যদিও রিক পড়াশোনায় খুব ভালো। বলতে গেলে ক্লাসের ফার্স্ট বয়। অন্যদিকে রহিত সাদামাটা টেনে-হেঁচড়ে পাশ করা ছেলে।
যাই হোক সময় মতো প্রকাশিত হলো রেজাল্ট। রিকের বাবার কথা মতো রহিতের রেজাল্ট আগে দেখা হল।
রেজাল্ট দেখা মাত্র অবিশ্বাসে ভরে ওঠে ওর চোখ। অবিশ্বাসের ঘোর কাটিয়ে , আবার একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে এক ছুটে , সারাটা রাস্তায় একটি বারও না থেমে চলে আসে মায়ের কাছে। রান্নাঘরে ঢুকে অবশ হয়ে যাওয়া শরীরে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে, "মা আমি সব সাবজেক্টে লেটার পেয়েছি। আর জানো! অঙ্কে একানব্বই। " কথাটা বলেই চোখ টপ টপ করে জল পড়তে থাকে রহিতের। খবরটা শুনে আনন্দ -উত্তেজনা-আবেগে শত চেষ্টা করেও চোখের জল ধরে রাখতে পারে না ছায়াদেবী। মূহুর্ত টা যেন ভেসে যাচ্ছে মা-ছেলের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুধারায়। প্রত্যেক ফোঁটা যেন জবাব দিয়ে যাচ্ছে এতদিনে ছায়াদেবীর মনে জমে থাকা অপমানের।
হ্যাঁ অপমান! সেই অপমান, যেদিন রিকের মা ছায়াদেবী রহিতের ক্লাস নাইনের রেজাল্ট বেরোনোর দিন টেনশন করছে দেখে বলেছিল, "কীসের টেনশন করছো?? রহিত টুকে-মুকে ঠিক পাশ হয়ে যাবে। টেনশন তো আমার বাপু, ছেলেটা ফার্স্ট হলো কি না কে জানে। "

কথাটা শুনে ছায়াদেবী মনের মধ্যে আঘাত টাকে চেপে রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, রহিতকে মাধ্যমিকে ভালো নম্বর পেতেই হবে। সেদিন থেকে ছায়াদেবী একদিকে যেমন রহিতের মা তেমনই অন্যদিকে তার শিক্ষিকা হয়ে উঠেছে।
দিন রাত এক করে নিজে উচ্চশিক্ষিত না হয়েও, রহিতকে পড়িয়েছে, সারারাত জেগে পাহারা দিয়েছে তাকে। ভালোবাসতে শিখিয়েছে পড়াশোনাকে।
আজ সেই শিক্ষিকা, না না মায়ের জয় হয়েছে। তাই চোখের জলের ফোঁটাগুলো যেন গর্বে উজ্জ্বল উঠছে। আর সানন্দে বলে যাচ্ছে সেই চির সত্যি কথাটাকে,,,,,,
   "পৃথিবীতে সবথেকে বড়ো ইচ্ছাশক্তি,
               আর তার চেয়েও মাতৃশক্তি । "
     




   Vill- krishnapur, p.o - madhabpur,
 dist - nadia, pin - 741164


অনুগল্প || রূপো বর্মন




ভুল এবং স্বার্থক 

রূপো বর্মন 

কাচড়া পাড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাসি নামে এক ছাত্রী পড়াশোনায় খুব ভালো। সাথে সে একটি নার্সারি স্কুলেরও ছাত্রী কারণ সে দু'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু হাসি প্রায় এক মাস ধরে দু'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অনুপস্থিত থাকায় কারণটা জানার জন্য এক দিন দু'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক শিক্ষিকারা তাদের বাড়িতে যায়।

তারপর তারা হাসির বাড়িতে গিয়ে জানতে পারল যে, হাসির বাবা মা দুজনেই শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত এবং তারা চার বোন। তার বাবা প্রায় সবসময় নেশা করে, তাস পেটায়, এমনকি লটারিও কাটে। তাই এসব বিষয় নিয়ে প্রায় বাড়িতে একটু একটু অশান্তি লেগেই থাকতো। তবে এক মাস ধরে হাসির বাবা প্রচুর পরিমাণে নেশা করছে, নানান ভাবে ধন সম্পদ ধ্বংস করছে। আর বাড়িতে এসে বউ বাচ্চাসহ বাবা মা সবার উপরে অত্যাচার করছে। তাই হাসি এই অশান্তির মধ্যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই উপস্থিত থাকতে পারেনি ।

সব কিছু শোনার পর হাসির বাবা কে শিক্ষক শিক্ষিকারা এবং উপস্থিত জ্ঞানী ব্যক্তি গুলো অনেক যুক্তিগত কথা বললো । এবং হাসির হাতে একটি বই ধরিয়ে দিয়ে পড়তে বলায়, হাসি যখন পড়তে পারল না। তখন একজন শিক্ষিকা জানাল যে, হাসি এই পড়াটা পড়তে পারতো এখন পড়তে পারছে না। এটি চর্চার অভাবে এবং পারিবারিক অশান্তির প্রভাব পড়ার ফলে ঘটছে। সব কথা শোনার পর হাসির বাবা খুব লজ্জাবোধ করল এবং হাসিকে জড়িয়ে ধরে বলল 'আমি একজন শিক্ষিত হয়েও আমার জীবনের সাথে সাথে আমার পরিবারেরও অনেক বড়ো ক্ষতি করতে চলেছিলাম। বিশেষ করে আমার চার চারটে মেয়ে হয়েছে বলে তাদের তেমন ভালো করে গুরুত্ব দিই নিই। আমি ভুলে গেছিলাম যে, ছেলে হোক আর মেয়ে সবার সমান অধিকার আছে। যার জন্য আমার মনের অশান্তি বেড়ে চলে ছিল আর আমি অযুক্তিগত ক্রিয়াকলাপ করতাম'। এই কথা গুলো বলতে বলতে তার চোখে জল চলে এসে ছিল।

হাসির বাবার কথা শুনে আর জল ভরা চোখ দেখে সবাই কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেছিল। হঠাৎ হাসি বলে উঠল "আজকের পর থেকে শুধু আমার বাবা নয়, পৃথিবীর সকল ছেলে মেয়েদের বাবা আর এমন অযুক্তিগত কার্যকলাপ করবে না। নিজের সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়বে।" তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট মেয়েটির কথাটি শুনে অনেক অভিভাবক এবং উপস্থিত সকলেই খুশি হয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ছিল। এবং দু'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষিকারা খুব খুশি হয়ে হাসির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কামনা করে তাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিল, সাথে আমিও। কারণ আমিও তাদের সাথেই ছিলাম, যাওয়ার সময় হাসিদের বাড়িটি চিনিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে শিক্ষক শিক্ষিকারা ওনাদের সাথে নিয়ে গেছিলেন। সেদিন স্বচোখে দেখলাম আর বুঝলাম যে, শিক্ষক শিক্ষিকারা শুধুমাত্র শিক্ষাদান করে না, তারা সত্যিই ছাত্র ছাত্রীদের বন্ধু এবং পথ প্রদর্শক। পরে শিক্ষক শিক্ষিকাদের পেছন পেছন একা একা হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম যে, ‌শিক্ষক শিক্ষিকারা ছাত্র ছাত্রীদের "বন্ধু এবং পথ প্রদর্শক" এই নামকরণটিকে আপনারা সত্যিই যথাযথ স্বার্থক করে তুলেছেন। আগামীতেও এমন শিক্ষক শিক্ষিকা পাওয়ার আশা রাখি।





গ্রাম - মৌজগাঁও 
ডাকঘর - বসিয়ান 
থানা - রায়গঞ্জ
জেলা - উত্তর দিনাজপুর


গল্প || মঙ্গলময় সিংহ





পুলিন

মঙ্গলময় সিংহ

পলাতখা সে অনেক দূরের পথ। ময়ূরগঞ্ঝ হয়ে যেতে হয়। মনটা বড়ো উথলা হয়ে উঠলো,জীবনে হয়তো এত দূরের পথ যাওয়ার কথা হচ্ছে। এই দিকে স্কুলে গরমের ছুটি পরে গেছে। বন্ধুরা যে যার মতো বেরিয়ে পড়েছে তাদের আত্মীয় বাড়ি। আর এই পুলিন ভাবছে আমি কবে যাবো। তার যে পড়ার ভীষণ চাপ, তাই তেমন ভাবে কোথাও যাওয়া হয় না। এই গরমের ছুটি পড়েছে এটা একটা ভালো সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। বাবা বাবা চলো না একটু কোথাও ঘুরে আসি। আমি জানি না, মাকে বল। মা মা চলো না কোথাও ঘুরে আসি। মা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন পাগল ছেলে এখন আবার কোথায় যাবি। আমাদের আটকুলে কেউ আছে নাকি। তোর মামার বাড়ি সেখানেও যাওয়া নেই।কোথায় যাবি বলতো।মা মা মাসীর বাড়ি চলো না কতো দিন যায়নি খুব মজা হবে। পাগল ছেলে সেও তো যাওয়া হয়না। তা কি হয়েছে যাওয়া হয়না, যাও না তাই যাওয়া হয় না। চলো না মা এই গরমের ছুটিতে যায়। গুড্ডু দাদাও বাড়িতে থাকবে,গুড্ডু দাদারও গরমের ছুটি চলছে। ওগো পুলিনের বাবা ছেলে যে দিদির বাড়ি যেতে চাইছে কি করবো গো। যাও তুমি তাহলে কিছু দিন তুমি থেকে আসো, ছেলের আবদার টা মিটবে। সেকি গো তুমি যাবে না। নাগো আমার তো আর স্কুল নয় যে ছুটি পড়ে যাবে। আমাকে তো কাজে যোগ দিতে হবে। বাবা বাবা তুমি যাবে না আমাদের সঙ্গে চলো না বাবা। তুমি যাও বাবা তুমি ফিরে এসে অন্য কোথাও আমি ছুটি করে তোমাকে নিয়ে যাবো। কি মজা বাবা আমাকে আবার অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে। পুলিনের মাসীর বাড়ি যে একান্নবর্তী পরিবার সেটি পুলিন জানত না। ভাবত মাসী মেসো আর গুড্ডু দাদা থাকতো। ওগো তাহলে আমরা বেরোলাম। তুমি সময়মতো খাওয়া দাওয়া টা করো কিন্তু, সময়মত ঘুমিয়ে পড়বে। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। বাবা যাচ্ছি টাটা। 

পুলিন হয়তো কোনো দিন ট্রেনে চেপে কোথাও যায়নি। এই প্রথমবার ট্রেনে চাপবে। মা ও মা এটা কি, এত বড় এটাকে কি বলে! 

এটাকে বলে ট্রেন বাংলায় রেলগাড়ি। এতো বড়ো হয়। হ্যাঁ এই গাড়ি খুব বড়ো।

চলো চলো উঠে এসো আমার সঙ্গে আমার হাত ধরো ভালো করে। বসে পড়ো। জানলা দিয়ে হাত বের করবে না। রেলগাড়ি ছাড়লো হুইসেল দিয়ে। মা মা এটা কিসের আওয়াজ। ট্রেন ছাড়লো বাবা।

ও মা দেখো দেখো গাছ গুলো কেমন দৌড়ে চলেছে। না গাছ দৌড়াচ্ছে না। গাছ ঠিক আছে ট্রেন ছুটছে। তুমি বইয়ে পড়েছো না সূর্য এক জায়গায় স্থির পৃথিবী ঘুরে চলেছে, ঠিক তেমনটি। 

চলো এবার নামতে হবে যে। স্টেশনে মাসী আনতে এসেছে। ও মা ওই দেখো মাসী। চল তোরা টোটো করে চল আমি যাচ্ছি তোদের পিছু পিছু। ও মা চারিদিকটা দেখো কতো সুন্দর। হ্যাঁ গ্রামের সব কিছু ই সুন্দর হয়। চলো বাড়িতে যায় আরো অনেক সুন্দর জিনিস দেখতে পাবে।

আমরা যাওয়ার আগেই মাসী চলে গেছে বাড়িতে। মা মাসী কি করে আগে গেলো আসলে তোমার মাসীর সব কিছুই তো চেনা তাই অন্য রাস্তা দিয়ে হয়তো চলে গেছেন। এসো দিদি এসো পুলিন এসো। মাসী গুড্ডু দাদা কোথায় আগে বলো। ও তোমার গুড্ডু দাদা পড়তে গেছে। এসো তুমি এসে বসো গুড্ডু দাদা এই আসলো বলে। কিছু খেয়ে নাও কতো দূর থেকে এসেছো। কি দিদি জামাইবাবু এলো না কেনো। তোমার জামাইবাবুর কাজের ভীষণ চাপ। আর পুলিনের গরমের ছুটি পড়লো তাই চলে এলাম আর তোমার জামাইবাবু বললো যাও দুইদিন ঘুরে এসো। ভালো করেছো দিদি তোমরা তো আর আসই না। এই এলে কি যে ভালো লাগছে। তা দিদি তোমার কর্তা মশাই কোথায়, হ্যাঁ ও একটু বেরোলো এই আসবে এবার গুড্ডু কে সঙ্গে করে নিয়ে। ওই তো গুড্ডু দাদা কি মজা। দাদা তোমার আসার এখন সময় হলো বলো যাও তোমার সঙ্গে আরী। না পুলিন আমি তো পড়তে গেছিলাম। কি জামাইবাবু ভালো আছেন। মনে আছে তো। কী বলো মনে থাকবে না একমাত্র শালিকা বলে কথা,ভুলে গেলে হবে। ভালো আছো তো? দাদা ভালো আছে। হ্যাঁ হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। 

মা মা আমি গুড্ডু দাদার সঙ্গে গেলাম। এই দেখ পুলিন ভাই এই সব বাড়ি আমাদের। কি বলো গুড্ডু দাদা। আসলে আমাদের পরিবার অনেক বড়ো যে আমার দাদুরা তিন ভাই আর আমার বাবা পাঁচ ভাই তাই সব মিলিয়ে এত বড়ো। একান্নবর্তি পরিবার বলতে পারিস। এখন হয়তো পরিবার গুলো তেমন নেই। সব সময়ের গতিতে আলাদা হয়ে গেছে। ছাড় ভাই এই সব কথা চল আমরা বরং মাঠ থেকে ঘুরে আসি। আজ তো সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দাদা। তাতে কি হয়েছে তোর কি ভয় লাগছে নাকি। আজ আর যেতে হবে না গুড্ডু দাদা। কাল যাবো। একটু দেখে চলে আসবো কিচ্ছু হবে না আমি আছি তো।

ওই মাঠ থেকে পুলিন একটি পুরনো ভাঙ্গা বাড়ি দেখতে পেলো। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় গুড্ডু দাদা কে বলা সত্ত্বেও নিয়ে গেলো না। পুলিন ওই বাড়িটি তে কখন যাবে সেই চিন্তা করতে লাগলো। পরের দিন আবার গুড্ডু দাদা কে সঙ্গে করে নিয়ে সেই বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা করলো। দাদা বারণ করলো যাসনা ভাই। সে কথা কে শোনে। গুড্ডু দাদা কে সঙ্গে করে নিয়ে গেল ঠিকই হটাৎ বাড়ি থেকে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েই দৌড়ে কোথায় পালালো আমি আর খুঁজে পেলাম না। কিন্তু পুলিন একাই যেতে লাগলো। হটাৎ পিছন থেকে কে যেনো ডাকলো ও দাদু ভাই কোথায় যাচ্ছো তুমি। কে ডাকে আমাই। দাদুভাই ভয় পেয় না আমি তোমাকে কিচ্ছু করবো না তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছো। হ্যাঁ দাদু দেখতে পাচ্ছি। তুমি কোথা থেকে এলে। আসলে আমি এই বাড়িতে তোমার মতো একটি দাদু ভাইয়ের সঙ্গে আমি থাকতাম কিন্তু হটাৎ একদিন দাদু ভাই কে আমি হারিয়ে ফেললাম। আমার বয়স হয়েছে আস্তে আস্তে আমি মারা গেলাম কিন্তু দাদু ভাই কে আর দেখে যেতে পারলাম না। এই কষ্টে বেচেঁ ছিলাম। কিন্তু তোমাকে আসতে দেখে আমি আমার দাদু ভাই কে তোমার মধ্যে দেখতে পেলাম। তাই আমি চলে এলাম। তোমার নাম কি দাদু ভাই। দাদু আমার নাম পুলিন। পুলিন তোমার জন্য আমি সব বেদনা ভুলে আবার স্বর্গে যেতে পারলাম। দাদু ভাই তুমি ভয় পাওনি তো, না দাদু। তাহলে আমি আসি দাদু ভাই। ভালো থাকবে।

এই ভাবে পুলিন বাড়িতে এসে পড়লো। এসে তো গুড্ডু দাদা সবাইকে বলে দিয়েছে। আমি তো ভয়ে। গুড্ডু দাদা আমাকে একা রেখে চলে গেছে আমি কী করবো। তা গুড্ডু দাদা তো তোমাকে বারণ করেছে। তা তুমি শোনো নি কেনো। ভুল হয়ে গেছে মা। জানো না বড়ো দের কথা শুনতে হয়। আর ভুল হবে না মা।

ঠিক আছে যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো দিয়ে খেয়ে নাও। পরে গুড্ডু দাদা কে সব কথা বলা মাত্র গুড্ডু দাদা ভয় পেলো। হ্যাঁ ওই জন্য তো আমি যায়নি ওই বাড়িতে, ভুতুড়ে বাড়ি যে ওটা। কিন্তু সব শোনার পর পুলিনের সাহস দেখে গুড্ডু দাদা অবাক। পুলিন তুই সত্যিই সাহসী।

বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে হবে। এতো দিন গুড্ডু দাদার সঙ্গে কাটানো দিন সত্যিই পুলিন মিস করবে। গুড্ডু দাদাও মিস করবে। এই দিকে গরমের ছুটিও ফুরিয়ে আসছে বাড়ির কাজ করতে হবে। 

বাড়ি ফিরে এসে মা কে ঘটনাটা বললে মা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় নি। পরে মা ও বিশ্বাস করলো এবং সাহসের প্রশংসা করলো। সত্যিই পুলিন এই বয়সে এমন দুঃসাহসিক কাজ করতে পারল। ভয় করলো না তোর। বাবা কে বললেও বাবাও আনন্দে প্রশংসা করেন। সত্যিই আমাদের পুলিন কতটা বড়ো হয়ে গেছে। পুলিনের এই সাহস সত্যি প্রশংসনীয়। এই দিকে স্কুল খুলে যাচ্ছে। আর হয়তো এমন ঘুরতে পারবো না। আবার একটি বছরের অপেক্ষা।



গল্প || স্বপন মণ্ডল





ব্রজেনের মা 

স্বপন মণ্ডল

মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না। সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। লোকের বাড়ি ভাড়াভেনে, ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না। সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। লোকের বাড়ি ভাড়াভেনে, ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না। সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। লোকের বাড়ি ভাড়াভেনে, ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না।



নিমাই সরদার রাঁচির মানুষ। মুন্ডা সম্প্রদায়। তাগড়াই চেহারা এবং গায়ের শক্তির জন্য খাতির ছিল সব মোড়লের কাছে। ষাট কেজির ধানের বস্তা একা একাই কাঁধে তুলতে পারত। ফসলের বোঝা মাথায় নিত সবার থেকে বড়ো। নিমাইয়ের হাঁটা চলায় এই গৌরব ঠিকরে পড়তো সব সময়। ব্রজেনের মায়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয় রক্তখালির মাঠে। পান্তার হাঁড়ি মাথায় নিয়ে ব্রজেনের মা সাত সকালে আলের উপর এসে দাঁড়ায়। লাঙল ছেড়ে নিমাই এগিয়ে যায় হাঁড়ি নামিয়ে নিতে। আষাঢ় মাসে প্রথম সকালের রোদ জেল্লা দিচ্ছিল খুব। নিমাই ব্রজেনের মায়ের অনাবৃত বাহুযুগল থেকে চোখ সরাতে পারেনি। এরপর এক সন্ধ্যায় মোড়লবাড়ির গোয়াল ঘরে গরু বাঁধতে গিয়েছিল নিমাই। ব্রজেনের মা  হঠাৎই তার হাত চেপে ধরে। কী কথা বলেছিল তা জানা যায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা একজন দেখে ফেলতে পাঁচ কান হয়। বর্ষার কাজের মরসুম শেষ হতে নিমাইয়ের কাছে কৈফিয়ৎ চায় মোড়ল। নিমাই বলেছিল, সে বিয়ে করতে চায় ব্রজেনের মা’কে। বিষয়টি বিচার সালিশী পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু দশের বিচারে অপমান ছাড়া কিছুই জোটেনি। আদিবাসী নিমাই পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে পারে না। সমাজের জাত যাবে। বিচারসভার রায়ে ব্রজেনের মা’কে পাড়াছাড়া হতে হয়। দয়াবশত চুনকালি মাখানো হয়নি মুখে। তবে বিশ-পঞ্চাশটা চোখ একসঙ্গে ঘেন্না ছুঁড়ে দিয়েছিল তার দিকে। পাড়ার মেয়েরা বলে, ‘‘শরীলির জ্বালায় জাত-ধর্ম হারিয়ে ফিলেছে মাগি! ছাবালডার কথাও ভাবল না! দূর দূর ঝাঁটার বাড়ি তোর মুখে।” মাইনের ধান থেকে দু’মন কাটা যায় নিমাইয়ের।

পৌষ মাসের শেষে বনবিবি প্রতিমার চক্ষুদান করছিল শিবপুটো। পয়লা মাঘ বনবিবির হাজত। সন্ধ্যা নামতে ঠাণ্ডা পড়েছে জমিয়ে। শিবপুটো কাঁথাটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। টেমিটা দেলকোর উপর বসিয়ে তুলিতে রঙ লাগায়। তারপর কিছুক্ষণের জন্য দম বন্ধ হয়। শরীরের সব কম্পন থামিয়ে ফুটিয়ে তোলে দেবীচোখ। দম ছেড়ে সোজা হয়ে বসতে যাচ্ছিল। এর মধ্যে খড়ের গাদার একপাশে কিছু একটা খড়মড় শব্দ হতে ফিরে তাকায়। দেখে অন্ধকারের মধ্যে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে ব্রজেনের মা। এগিয়ে এসে বলে, ‘‘বনবিবির শরীলি অত জেল্লা দিয়ো না ঠাকুরপো। যত জেল্লা তত জ্বালা।” শিব চৌকি এগিয়ে দেয় বসতে। ব্রজেনের মা বলে,

‘‘এট্টা বিধান নেব বলে তোমার কাছে আইচি ঠাকুরপো। নিমাই আমারে নে পালাতি চাচ্ছে শওরে। কী করব?’’

শিবপুটো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “ছেলেটার কী হবে?’’ ব্রজেনের মা বলেছিল,

“আমি বাঁচলিও ব্রজেন গরুর রাখাল, মরলিও গরুর রাখাল। না খেয়ে তো মরবে না।”

শিবপুটো পাঁচালি সুর খেলিয়ে বলে ওঠে,

“দয়ার মা বনবিবি বনের মাঝারে, মুসকিলে পড়িয়া ডেকো মা বলিয়া তারে”।

ব্রজেনের মা খড়ের গাদার গায়ে শরীর সেঁটে দিয়ে বলে, ‘‘বনের বাঘ বনবিবি মায়ের কথা শুনতি পারে ঠাকুরপো, কিন্তু শওরের বাঘ কি শোনে?’’

চক্ষুদান হওয়ার পর প্রতিমার শরীরে আবরণ দরকার হয়ে পড়েছে। ঘাড়ের গামছাটা বনবিবির শরীরে ফেলে দেয় শিবপুটো। রঙের খুলিতে তুলি ঘোরাতে ঘোরাতে কিছু ভাবছিল সে। ব্রজেনের মা বলল,

‘‘যদি বাঁচি, সারাজেবন তোমারে ভগবান মানব ঠাকুরপো। আমার ছেলেডারে দিখো এট্টু।’’

শিবপুটো কোনো উত্তর করেনি। বাম হাতের তালুর পিঠে তুলি ঠুকে রঙের গতি সামলে নেয়। তারপর বনবিবির কোলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুখের চক্ষু দান করে। মুখ না ফিরিয়ে শিবপুটো বলে,

‘‘দুখে বনবিবির দয়া পেয়ে রাজা হয়েছিল জানো তো?’’

পিছন থেকে কোনও উত্তর আসেনি। শিবপুটো তাকিয়ে দেখে ব্রজেনের মা চলে গেছে। সেই রাতে সারারাত ঘুম পাড়াতে পারেনি সে। অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্তে আসে, ব্রজেনের মায়ের পালিয়ে যাওয়াই ভাল।

সকালের কুয়াশা সরে যেতেই শীতের রোদ উজ্জ্বল হয়। কপিখেতের পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছিল শিবপুটো। এই সময় খেয়াঘাটের দিক থেকে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসে দীননাথ। খানিকটা দম নিয়ে বলতে শুরু করে নিমাই এবং ব্রজেনের মায়ের পরিণতির কথা। গভীর রাতে কলোনিপাড়ার নদীচরে নেমে যায় ব্রজেনের মা। দত্ত নদীর ওপার থেকে নৌকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল নিমাই। চাঁদনি রাতে সেই নৌকা মাঝনদীতে দিশাহীনভাবে ঘুরপাক খায় স্রোতে। তারপর শেষভাটায় নৌকা ছেড়ে উঠে যায় ওরা। ব্রজেনের মা’কে সায়া-ব্লাউজ আর রঙীন কাপড় পরিয়ে খোপায় ফুল গেঁথে দেয় নিমাই। তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিল কোথাও। কিন্তু সব প্রস্তুতি নিয়েও কোথায় যে তাদের বাধলো সে কথা জানে না দীননাথ। নিজে চোখে দেখে এসেছে ঘরের দরজার মুখে গ্যাঁজলা উঠে মরে পড়ে আছে নিমাই আর ব্রজেনের মা। কৌতূহলী মানুষ এগিয়ে যাচ্ছিল খেয়াঘাটের দিকে দলে দলে। কলসি কাঁখে জল আনতে যাওয়া মেয়ে বউরা ছি ছি করতে করতে মুখে কাপড় চাপা দেয়। মোড়লেরা বলে, ‘‘ঘোর কলি, ঘোর কলিকাল!’’ শিবপুটো ধীর পায়ে উঠে গিয়েছিল প্রতিমার কাছে। শাড়ি ব্লাউজ এঁকে দিয়েছিল বনবিবির শরীরে। তারপর জোড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুখেকে মনের মতো করে সাজিয়ে বলেছিল, ‘‘ব্রজেন, তোমার মা’কে ভুল বুঝো না।’’




Bakul Apartment, 18/2, Kalikapur, Kolkata-99, Mobile-9674315968



গল্প || চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জী




নির্ভরতা

চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জী

                         (১)

বেশ কিছুক্ষণ হলো বাসস্টপে আমি দাঁড়িয়ে।বাবিনের স্কুলবাসের  অপেক্ষায়। কখন যে আসবে। আর ভালো লাগছে না। স্কুল বাসটা নির্দিষ্ট সময়ের থেকে একটু দেরি করলেই বুকের  ভেতরটা কেমন যেন ধড়াস ধড়াস করে। আজ তো দুটো বেজে গেল। কই এখনো তো হলুদ স্কুল বাসটা এলো না। সাথে অবিনাশও পাল্লা দিয়ে ফোন করে চলেছে। ছেলে অন্ত প্রাণ সে। দুটো বাজার সাথে সাথে ফোন আসবেই আসবে। ছেলে স্কুল থেকে ফিরল কি না।আজই তো বাবিনের স্কুলে লাস্ট ওয়ার্কিং ডে। আগামী কাল থেকে পুজোর ছুটি পড়ে যাচ্ছে।  ঘড়িতে বার বার সময়টা দেখছি।।এর মধ্যে তিন বার অবিনাশের ফোন চলে এসেছে। প্রতিবার একই উত্তর আমাকে দিতে হচ্ছে। ওই তো বাসটা দেখা যাচ্ছে। যাক্ বাবা, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। স্কুল বাস থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাবিন নামছে। এই স্টপেজে সে একাই নামে। 


--- টা টা ,  বাস কাকু। হ্যাপি পুজা।


--- টা টা, আদিত্য। ভালো করে পুজো কাটিয়ো।


স্কুল বাসটা কচিকাঁচাদের কলরবে একদম জমজমাট। পুজোর ছুটি বলে কথা।

--- বাবিন, আজ তো লাস্ট ওয়ার্কিং ডে ছিল। কোনো টেস্ট কপি দিয়েছে কি?


-- হ্যা, মা।  ম্যাথ কপি দিয়েছে ।


--- কত পেলি?


--- টোয়েন্টি। আউট অফ টোয়েন্টি ফাইভ।


--- টোয়েন্টি!!! পাঁচ নম্বর কোথায় কাটল?

 তোকে এত পড়িয়েও , এই অবস্থা। তোকে নিয়ে আর পারিনা।


--- টোয়েন্টি তো পেলাম। তুমি তাতেও হ্যাপি না।


--- ওই টোয়েন্টি নিয়েই খুশি থাক্।


--- প্লিজ, আজকে কিন্তু সন্ধেবেলা পড়াতে বসাবে না। দিম্মা বলেছে আজ চতুর্থী। কাল পঞ্চমী। আজকে থেকে নো লেখাপড়া।দেখোনি আমাদের পাড়ায় দুগ্গা ঠাকুর এসে পড়েছে। চলো না মা, এখন একটু ঠাকুরটা দেখে আসি।


--- এখন যাব ঠাকুর দেখতে?এখন চান, খাওয়া সব বাকি!


--- প্লীজ ,প্লীজ। চলো না মা।


আমার সারাটা সকাল , দুপুর, সন্ধ্যে ও রাত ছেলেকে ঘিরেই কাটে। আমার সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত---পুরোটাই বাবিনকে দেওয়া।ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বাবিনের স্কুলের টিফিন তৈরি করা,  ছেলেকে ঘুম ঘুম চোখে দু গাল ভাত খাইয়ে দেওয়া। তার পর ছুটে ছুটে ছেলেকে নিয়ে বাসস্টপে পৌঁছানো। সত্যি কথা বলতে আমার টাইম ম্যানেজমেন্ট  কিন্তু যথেষ্ট নিখুঁত।বাবিন এতদিন স্কুলে পড়ছে, আজ পর্যন্ত একদিনও সে স্কুল বাস মিস করেনি।বাবিনের স্কুলে চলে যাওয়ার পর আমার শুরু হয় ঘরকন্নার সমস্ত কাজ। বছরের আদ্ধেকের বেশি সময় তো অবিনাশ কলকাতার বাইরে বাইরেই কাটায়।সে এখনো অফিস ট্যুরেই ব্যস্ত । পুজো তো প্রায় দোরগোড়ায়। সবাই মায়ের আসার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে।পাড়ায় পাড়ায় আলোর রোশনাই। বাড়ি ফেরার পথে দুগ্গা ঠাকুরকে দেখে বাবিনের মন খুব খুশি। ঠাকুর দেখে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বাড়ি চলে এল। খেয়ে দেয়ে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।বিকেলে ওকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো। এখনো পাড়ার মন্ডপে কিছু কাজ চলছে। ওগুলো দেখতেই বাবিনের আনন্দ, কি যে আনন্দ পায় কে জানে! সাথে আবার আমাকেও থাকতে হবে। আলমারি থেকে পুজোর জন্য কেনা জামা কাপড় গুলো বের করলাম। শাড়িগুলোর পাশে পাশে   ম্যাচিং করা জুয়েলারী গুলো রেখে দেখতে লাগলাম। পুজো আসলে সেই যেন শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যাই। ছোট্টবেলার মনটা ময়ূরের মত পেখম তুলে আনন্দে নাচতে থাকে। চারিপাশে শিউলি ফুলের মনমাতানো সুবাস। শরৎ কালের নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের ভেলা।


আজ অষ্টমী। সকালে অবিনাশ দিল্লি থেকে ফিরেছে। আমি বাবিনকে নিয়ে পাড়ার পুজো মন্ডপে অঞ্জলি দিতে এলাম। অবিনাশের বরাবরই অঞ্জলি দিতে অনাসক্তি।তার ওপর আজ সকালে বড্ড ক্লান্ত। একটা লম্বা ঘুম দিলেই একদম চাঙ্গা। আজ শুধু ঘুম আর ঘুম।


--- ও মা, আজ ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে তো?


অঞ্জলি দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতেই বাবিনের বায়না শুরু। উফ্! আর পারিনা আমি! একা হাতে সব সামলে। অবিনাশকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেচারা‌ আজ বড্ড ক্লান্ত। আর এদিকে ঠাকুর দেখার জন্য বায়না করছে বাবিন।বাবিনকে রঙিন পায়জামা পাঞ্জাবি পরে একেবারে ছোট কার্তিক ঠাকুরটি লাগছে।

মায়ের নজর যেন না লাগে।

--- ও মা, বলোনা, যাবে তো?


--- ওরে বাবা আগে তো বাড়ি যাই সোনা।


--- না, না। এখুনি বলো। সন্ধ্যে বেলায় যাবে তো?


--- আচ্ছা, আচ্ছা, নিয়ে যাব।


দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নিলাম। সারাটা দুপুর বাবিন অবিনাশের সাথে দস্যিপনা করে কাটায়। বাবাকে আর পায় কতটা সে! তাই যতটা সময় পায় সুদে আসলে সে মিটিয়ে নেয়।যাই হোক, সন্ধ্যেবেলায় আমি আর বাবিন সেজেগুজে  ঠাকুর দেখতে বেরোলাম। অবিনাশের ভিড় ভাট্টা পোষায় না। তাই সে এবেলাও বেরোলো না। আমার যে একটুও অভিমান হলো না, তা নয়।

কিন্তু কিছু করার নেই। অবিনাশ একটু এমনই। এত বছরে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছি। বাইরে বেরোতেই দেখলাম চারদিক আলোময়। রঙিন আলোয় ভাসছে সবকিছু। রাস্তায় বেশ ভীড়। অষ্টমীর সন্ধ্যেতে এমনিতেই ভীড় বেশি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভীড় ও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। শক্ত করে বাবিনের হাতটা চেপে ধরলাম।বাবিনও যথেষ্ঠ সাবধানী।জানে ভীড়ের মাঝে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেশ কিছুটা পথ  চলে এসেছি।বাবিনের বেশি চাহিদা নেই। একটু ফুচকা খেতে চাইল। আমরা দুজনে টক- ঝাল ফুচকা খেয়ে খুব খুশি। সামনের মন্ডপটায় প্রচন্ড ভিড়। প্রবল মানুষের চাপ। আবারও বাবিনের ছোট্ট হাতটা শক্ত করে ধরে নিলাম।এত ভিড়ে এগোনোটা বোধহয় ঠিক হবে না। ফিরেই যাবো, ঠিক করলাম। কিন্তু ততক্ষণে একটা ভিড়ের বড় ঢেউ এসে সবকিছু ছাপিয়ে গেল। আমার মুঠো থেকে ছোট্ট বাবিনের ছোট্ট হাতটা গলে বেরিয়ে গেল।আমি পাগলের মতন দিশেহারা হয়ে বাবিনকে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম। কোথায় ছিটকে গেল আমার বাবিন? দুচোখে অঝোর ধারায় নেমে এলো বর্ষা । মাথা আর কাজ করছিল না।বাবিনের মুখটা  বারবার শুধু মনে পড়ছে।আশে পাশে কোথাও তার চিহ্ন মাত্র নেই। শুধু অচেনা কালো মাথার ভিড়। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোর মাঝে বাবিনকে খুঁজে চলেছি। হঠাৎ করে মাথায় এল কর্ম কর্তাদের কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা। কোনোরকমে দৌড়ে পৌঁছে গেলাম মঞ্চের কাছে।


---- " বাবিন, তোমার মা, শ্রীমতি রঞ্জাবতী স্যানাল তোমায় খুঁজছে। তুমি যেখানেই থাকো , আমাদের মঞ্চের কাছে চলে এসো।তোমার মা এখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।" 


মন শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম।ব্যাকুল‌ নয়নে বাবিনের ফেরার পথ দেখছি।প্রতি টা মূহূর্ত মনে হতে লাগল এক একটা শতাব্দী। তার ই মাঝে বাবিনের কান্নার আওয়াজ। সাথে "মা"  বলে ডুকরে কেঁদে ওঠা। দুজন অল্প বয়সী ছেলে বাবিনকে খুঁজে পেয়ে নিয়ে এসেছে। হুড়মুড় করে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার সোনা মানিক। আমার পৃথিবী ফিরে পেলাম। বাবিনের কান্না ভেজা চোখে এক গভীর নির্ভরতার প্রকাশ।এ হাত সারাটা জীবন যত্ন করে ধরে রাখব আমি।


                        (২)


সানাইয়ের সুর বাজছে মাইকে। কিন্তু কিছু ভালো লাগছে না আমার। একটু আগে কত আনন্দ ছিল মনে।বেশ কিছু দিন পর  আমরা আজ একসাথে বাইরে বেরিয়েছিলাম  ঠাকুর দেখবো বলে। কেন‌ ‌‌যে  হাতটা ছাড়তে গেল মা। মায়ের বয়স হয়েছে।এখন আর বাইরে বেরোতে চান না। যতটা না বেরোলেই নয়। মহাষ্টমীর দিনটাতেই আমার ছুটি।অন্য দিনগুলোতে তো হসপিটালে ডিউটি থাকে। মায়ের ঠাকুর দেখার খুব ইচ্ছে। কিন্তু বয়সের ভারে সব ইচ্ছে গুলো উড়ে গেছে।জোর করেই একটু মাকে 'মায়ের" দর্শন করাতে নিয়ে আসা। প্রণাম করেই বাড়ি ফিরে যেতাম। কিন্তু এখন এই বিপত্তি। এখানে মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথায় যে গেলো মা। মা সাথে তো মোবাইলটাও রাখে না। মনে পড়ে গেল সেই ছোট্ট বেলার এক স্মৃতি।


--- "রঞ্জাবতী স্যানাল, আপনার ছেলে আদিত্য আপনার জন্য আমাদের এই মঞ্চে অপেক্ষা করছে।আপনি  যেখানেই থাকুন, এখানে চলে আসুন।"


কুড়ি মিনিটের অপেক্ষা যেন যুগ যুগান্তরের অপেক্ষা বলে মনে হচ্ছিল আমার।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। হঠাৎ পিঠে হাত। খুব চেনা স্পর্শ। মায়ের স্পর্শ।

কর্ম কর্তাদের ক'জন অশক্ত রণ্জাবতী কে ধরে ধরে  যত্ন করে নিয়ে এলো।


--- "কিরে বাবিন, কোথায় ছিলি তুই ? "

 রঞ্জাবতীর চোখ ভীত, সন্ত্রস্ত।


---" মা, এবার শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রাখবে। একদম ছাড়বে না। ছোটবেলায় যে ভাবে  আমি তোমার হাতটা ধরে রাখতাম, ঠিক সেভাবে তুমি আমার হাতটা ধরে রাখো।‌কোন ভয় নেই, আমি আছি তো!

আমি দৃঢ় , বলিষ্ঠ হাতে মায়ের কাঁপা, কাঁপা হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করলাম। রঞ্জাবতীর ‌চোখে তখন পরম নির্ভরতার প্রকাশ।।




3, Ramlal Bazar road
Post office Haltu
Kolkata 78



গল্প || সৌমেন দেবনাথ





পরার্থপরতা 

সৌমেন দেবনাথ 

মানুষকে চিনতে মানুষ ভুল করে না। যদিও মানুষের ভীড়ে মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কত রঙের মানুষ এই জীবধাত্রী ধরিত্রীর বুকে। যে যার কাছ থেকে প্রশংসা পাচ্ছে, তাকে সে মানুষ বলছে। যে যার সুখে-দুঃখে হাত বাড়াচ্ছে, সে তাকে মানুষ বলছে। আর যে যার কাছ থেকে একটু আঘাত পাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে, আশাতীত ব্যবহার পাচ্ছে না, তাকেই অমানুষের কাতারে ফেলে দিচ্ছে। সবাই চাইছে তাকে এসে কেউ প্রশংসা করুক, তার গুণকীর্তন করুক। কিন্তু মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হলো অন্যের নিয়ে সমালোচনা করা, অন্যের প্রতি হিংসা প্রকাশ করা, ঘৃণা করা। এই নেতিবাচক কাজগুলো আমরা সবাই করছি, আবার আমরা সবাই-ই চাইছি আমাদের স্তোব-স্তুতি করে না কেনো কেউ? আমায় সাবাস স্লোগান দেয় না কেনো কেউ? আমায় মাথায় তুলে রাখে না কেনো কেউ? নিজে যে আচরণ করি না, অন্যের কাছ থেকে সেইরূপ আচরণ প্রত্যাশা করা আমাদের যেন রক্তে মিশে আছে। নিজে কারো ভালো চাই না, অথচ মানুষ কেন আমার ভালো চায় না সেটা ভেবে চিন্তিত। মানুষের দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকি, আর আমার দোষ কেউ ধরলেই ভীষণ রকম চটে যাই।

আতিকুল খুবই পরোপকারী মানুষ। মানুষের জন্য কিছু করার প্রবল ইচ্ছা তার ভেতর রয়েছে। মানুষ হয়ে যদি মানুষের পাশেই না দাঁড়াতে পারলো তবে কিসের মানুষ! অন্যের কষ্টে ব্যথিত হয়, অন্যের অভাবে ভারাক্রান্ত হয়, অন্যের বিপদে জর্জরিত হয়। মানুষের পাশে দাঁড়ালে সেই মানুষই তাকে আবার সন্দেহ করে। মানুষকে সাহায্য করলে মানুষই তাকে বলে, অন্যের জন্য এত দরদ কিসের, নিজের চরকায় তেল দাও।

আতিকুল অবাক হয়ে যায় মানুষের এমন কথা শুনে। নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করতে গেলেও মানুষ অতি কথা শোনায়। কাউকে সাহায্য করলে মানুষ বলে, আপনি এত সাহায্য করেন কেনো? মানুষের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য খুব কাতর না? পরার্থে হাত প্রসারিত কোন স্বার্থে?

আতিকুল এমন অপ্রত্যাশিত শব্দ উচ্চারণ শুনে থমকে যায়। কাউকে সাহায্য করবে না, আবার কেউ সাহায্য করলে বাধা দেবে, এই হলো মানুষের স্বভাব। আতিকুলের আরো একটি স্বভাব আছে, যখন অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারে না, তখন উপদেশ দিয়ে সাহায্য করে। উপদেশ দিতে গেলেও সে বাধার সম্মুখীন হয়। কেউ বলে, আপনি উপদেশ দেওয়ার কে? পেটে নেই জ্ঞান, উপদেশের ঢিল ছোঁড়ে। জ্ঞান বিলাতে সবাই চায়, জ্ঞান নিতে কেউ চায় না। অথচ জ্ঞানের অভাবই সবার ভেতর বেশি।

এসব কথা শুনে আতিকুলের খুব খারাপ লাগে। কাজ করে, অথচ প্রশংসা পায় না। পরার্থে কাজের বিনিময়ে সে কিছু চায় না, কিন্তু মানুষ কেনো বাজে কথা শোনাবে! সমালোচনা শুনলে তার খুব খারাপ লাগে।

নিঃস্ব জেলেদের জাল কিনে দিয়েছে আতিকুল। অন্য জেলেরা তার উপর ক্ষিপ্ত হলো। ভালো কাজ করতে গেলেও মানুষ ভালো ভাবে নেয় না। যার প্রয়োজনে আসে, সেই শুধু একটু দুয়া করে দেয়, বাকিরা তাকে শত্রু ভাবে। ভালো কাজ যারাই করতে যায়, তাদের পিছনে মানুষ লাগে। কিন্তু ভালো কাজ করা যাদের নেশা, তারা এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে থেমে যায় না। কষ্ট পেলেও পরক্ষণে সে কষ্ট ভুলে যায়। মহৎ হৃদয়ের মানুষ ভালো কাজ করা থেকে কখনো পিছুপা হয় না। সে জানে খারাপ কাজ করলে যত না বাধা আসে, ভালো কাজ করলে তারচেয়ে বেশি বাধা আসে। ভালো কাজ করেছে বলে কত মানুষই সন্দেহের তালিকায় পড়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ভালো কাজ করে যারা তাদের সামনের মানুষ হাততালি দেয়, আর পিছনের মানুষ হাত ভেঙে দেয়।

আতিকুল একদিন সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষকের কাছে গেলো। স্যারকে জিজ্ঞাসা করলো, স্যার, ভালো কাজ করলে মানুষ ভালো না বলে মন্দ বলে কেন?

স্যার বললেন, ভালো কাজ মানুষ মৌসুম বুঝে করে। মৌসুম বুঝে ভালো কাজ করে যারা, তাদের কাজের পিছনে নিজস্ব উদ্দেশ্য থাকে। সারা বছর কাজ করলে মানুষ প্রশ্নিল চোখে তাকাবে না। 

আতিকুল স্যারের কাছ থেকে উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হলো। ভালো কাজ করার ধারাবাহিকতা যারা রক্ষা করে তারাই ভালো। লোক দেখানো ভালো কাজ করার মানুষ সমাজে বেশি বলেই সেসব ভালো কাজগুলোকে সমাজের মানুষ ভালো চোখে নেয় না।

এলাকার ছোট একটা প্রতিষ্ঠানে আতিকুল কাজ করে। সেখানেও সহকর্মীদের প্রয়োজনে অর্থ ধার দিয়ে সাহায্য করে। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোনো সহকর্মী অন্যায় করলেও তাকে আগে রক্ষা করে। এত কিছুর পরও যখন ঐসব সহকর্মীরা তাকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করে এবং সে অন্য কারো মাধ্যমে শুনতে পারে তখন তার ভীষণ রকম খারাপ লাগে। যায়-ই করতে যায় বুমেরাং হয়ে নিজেকেই বিদ্ধ করে। এই বিদ্ধতা সে সহ্য করতে পারে না। মানুষকে উপকার করে লাভ কি তবে? যাদের হিতার্থে কাজ করে সে, তারাই প্রতিহিংসাপরায়ণ।

বাড়ি এলে আব্বা বকেন। নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে বলেন। অন্যের জন্য কাজ করাকে নিরুৎসাহিত করেন। আব্বা অভিজ্ঞ মানুষ। তারপরও ভালো কাজে উৎসাহ না দিয়ে বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাবা বলেন, উপকার যে করে তার শত্রু বেশি। উপকারীকে বাঘে খায়। ইভটিজিং রুখতে গেলে তোর প্রাণও যেতে পারে। পক্ষ-পাতিপক্ষের দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে তুই দুই পক্ষেরই রোষানলে পড়বি। মানুষকে সাহায্য করার হৃদয় তোর আছে, চলতি পথে কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করবি কর, কিন্তু এই সাহায্য করার ব্যাপারটা ঘটিয়ে-রটিয়ে করিস না। ভালো কাজের কদর নেই, ভালো মানুষের দাম নেই। যত তুই ভালো ভালো উদ্যোগ নিবি, তুই তত ফাঁদে পড়বি।

আতিকুল থেমে যায়। কাজ করার স্পৃহা তার যেমন প্রবল, সমালোচনা সহ্য করার ধৈর্য তত নেই। হিতে যে বিপরীত ঘটবে, সেই বিপরীত সহ্য করার সামর্থ্য তার নেই। অপরিচিত মানুষ অনিষ্ট করলেও কষ্ট লাগে না, পরিচিত মানুষ বিনষ্ট চাইলে তার কষ্ট সহ্য করা যায় না। কিন্তু মানুষের স্বভাব বদলায় না, হোক সে বদ অভ্যাস, কিংবা ভালো অভ্যাস।

গ্রামে মধ্যবয়েসী এক বিধবাকে ছাগল কিনে দিয়েছে সে। একটি সেলাই মেশিন কিনে দিতেও সহয়তা করেছে। বিধবা মহিলা তাকে একবেলা রান্না করে খেতে দিয়েছে। ওমনি পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে গুঞ্জণ শোনা গেলো বিধবার সাথে তার সম্পর্ক। 

বিয়ে না করাটা ভালো কাজ করার পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ানোতে সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো। ছেলে বিয়ের জন্য রাজি শুনে আব্বা আম্মা খুশি হলেন। মেয়ে দেখতে গেলো। মেয়ে পছন্দ। মেয়ের আব্বার অনেক সম্পদ। বিয়েতে অনেক খরচ করবে জানতে পেরে আতিকুল বললো, বিয়ের অনুষ্ঠানমালা না করে সেই টাকা এতিম অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দিলে অনেক ভালো কাজ হবে।

একথা জানতে পেরে মেয়ের আব্বা যৎকিঞ্চিৎ চিন্তিত হলেন। তারপর মেয়ে জামাইকে কি কি দেবেন সবিস্তারে জানালেন। আতিকুল ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো, আমি কিছুই নেবো না। আমি মানুষের জন্য কাজ করি, আর আমি নেবো যৌতুক?

মেয়েপক্ষের সবাই আশ্চর্য হলেন। যে ছেলের চাহিদা নেই, সে ছেলে জীবনে বড় হতে পারবে না। যে ছেলে পাওয়া জিনিসও নেয় না, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল না। প্রাপ্তির আশা মানুষের স্বভাবজাত গুণ। সেই গুণ যার ভেতর অনুপস্থিত, তার ভেতর সমস্যা আছে, নতুবা মনস্তাত্ত্বিক ভাবে দেউলিয়া। বর্ণহীনভাবে যে ছেলে বিয়ে করতে চায়, তার জীবন বর্ণিল হবে না। আতিকুলের সাথে তাঁরা মেয়ে বিয়ে দিলেন না।

ফেরার পথে আব্বার সাথে আতিকুলের কথা হচ্ছে। আতিকুল বললো, দেখেছো আব্বা, সৎচিন্তার কোনো দামই নেই। সুস্থচিন্তা করলাম বলে অপমানিত হলাম।

আব্বা বললেন, তুই যে বোধ ধারণ করিস সেই বোধে সমাজ এখনো পৌঁছায়নি। আমি তোকে এই সুস্থচিন্তার শিক্ষা দেইনি, শিক্ষালয় তোকে এই সুস্থচিন্তার  শিক্ষা দেইনি, অথচ তুই সেই সুস্থচিন্তার ধারক। বোধ-বিবেক জাগ্রত না হলে এই সুস্থচিন্তা আসে না। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া তোর মত সন্তান পেয়েছি।

এভাবে দিন যায়, মাস আসে। বেতনের বড় একটা অংশ দুস্থদের মাঝে বিলিয়ে দেয় সে। কর্মের মধ্যেই প্রকৃত পরিচয়। চলার পথে গরীব-দুঃখী দেখলেই পকেট থেকে টাকা বের সহায়তা করে। গরীব-দুঃখী মানুষের মুখের হাসি দেখলে তার হৃদয়টা ভরে যায়। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সাধ্যমত অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। শীত মৌসুমে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ায়। বেকার যুবকদের ভ্যান কেনার টাকা ধার দেয়। গ্রামের এক ধনী লোক এসে বললেন, তুই কি গ্রামে ঋণের ব্যবসায় শুরু করবি? যাকে তাকে টাকা ধার দিয়ে লোভ দেখাচ্ছিস?

আতিকুল মাথা উঁচু করে লোকটার মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। ভালো কাজ করলেও ভিলেন হতে হয় সমাজের চোখে, সমাজের মানুষ এমন কেন? এমন আচরণ পেলে কাজ করার উদ্যমতা হারিয়ে যায়। 

গ্রামে এক রোগিনী আছেন। একটিই মেয়ে সন্তান থাকাতে সংসারে আয়-রোজগার নেই। মা মেয়ের কষ্ট প্রায়ই দেখে আতিকুল। উপকার করতে পারলে ওর ভীষণ ভালো লাগে। কোন দিন বাজার করে দেয়, কোন দিন ঔষুধ কিনে দেয়। এ কারণে ও বাড়িতে আতিকুলের আসা যাওয়া পড়ে। কিছু দিন পরেই গুঞ্জণ শোনা গেলো, আতিকুল রোগিনীর মেয়েকে পছন্দ করে। আতিকুল আকাশ থেকে পড়ে। ঘর থেকে বাইরে বের হতে ওর লজ্জা লাগে। চাচা এসে বললেন, ভাই, আতিকুলকে বিয়ে দিয়ে দাও। বিয়ে দিয়ে দিলে ছেলে ভালো হয়ে যাবে।

আব্বাও তার ভাইয়ের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলছেন। দুদিন বাদেই একদল মানুষ এলেন। আতিকুলকে দেখতে এসেছেন। ছেলে কি করে জানতে চাইলে পাশ থেকে এক প্রতিবেশিনী বললেন, দান করে।

কথাটি তিনি এত তুচ্ছতার সাথে বললেন যেন দান করা খারাপ কাজ। যাকে সাহায্য করা দরকার তাকে সাহায্য না করে যাকে সাহায্য করা দরকার না তাকে সাহায্য করলে আবার এসব শত্রু জন্মাতো না। মেয়েপক্ষের একজন বললেন, দান করা ভালো গুণ, সাহায্য করার অভ্যাস ভালো অভ্যাস, কিন্তু তার আগে তো স্বচ্ছল হতে হবে। 

আতিকুল বললো, স্বচ্ছল হওয়ার পর সাহায্যের হাত প্রসারিত করার চিন্তাটাও ভালো না। যে যেই অবস্থানে আছে সেখান থেকে মানব কল্যাণে কাজ করতে হবে। অল্প দিনের দুনিয়া, আজ আছি কাল নেই। আত্মচিন্তা বাদ দিয়ে আত্মনিবেদিত হতে হবে।

মেয়েপক্ষের মধ্যে একজন বিজ্ঞ আছেন। তিনি ভাবলেন, বিয়ের আগে ছেলেরা এমন উদারমনস্ক থাকে। কত কত সামাজিক কাজ করে। বিয়ের পর সংসারের চাকা টানতে থাকলে এসব উদারতা ছুটে যাবে। ছেলেটার মানসিকতা ভালো। 

এরপর মুখে উচ্চারণ করে তিনি বললেন, আমাদের মেয়ে ঢাকায় থেকে পড়ে। ঢাকায় তোমাকে চাকরি দিয়ে দেবো। তোমাকে ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে দেবো, পারলে কিছু টাকা তুমিও দিও।

আতিকুল একথা শুনে আশ্চর্য হলো। এত এত চাহিদা মেনে নিয়ে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। একটি চাহিদাও সুন্দর না। প্রসারিত হাত যার, প্রসারিত হৃদয় যার এমন অপ্রত্যাশিত আর অযাচিত কথা মেনে নেবে না সে। সে কোনো লোভী মাছ নয় যে, টোপ দেখলেই গিলবে। ওর মন সংকীর্ণ নয় যে, সুবিধা দেখলেই সিদ্ধান্ত বদলে নেবে। 

এ বিয়েটাও ভেঙে গেলো। মেয়েপক্ষের একজন বেশ শব্দ করেই বললেন, চাল নেই, চুলো নেই, দানশীল মহসীন! আয়ের গুণ নেই, ব্যয়ের গুণ আছে। দুশো চারশো দান করে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করা যায় না।

আব্বা আম্মার মুখের দিকে চেয়ে থেকে আতিকুল কেদে দেয়। আব্বা বলেন, তুই এত এত ভালো কাজ করছিস, কিন্তু তোর শুভাকাঙ্ক্ষী না বেড়ে কমছে, তোকে কেউ পছন্দ করছে না, এখন তুই ভাব তোর কি করা উচিত।

আম্মা বললেন, তোর দ্বারা কোনো বিঘ্ন ঘটবে না, কারো অপকার হবে না এটা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তোকে ঘর-সংসারও করতে হবে, তোর অর্থ-কড়ি ও দরকার। বলছি না, তুই অর্থ বিনষ্ট করিস, কিন্তু তোর এই অর্থ খরচের লাগাম টানা দরকার।

আতিকুল কোনো কথা না বলে নিজ রুমে চলে গেলো। একদিন বাজারে পাঁচ সাতজনের একটি দল আতিকুলকে ধরলো। সবাই এলাকার সন্তান, সন্তান মানে মস্তান। একজন বললো, মানুষকে টাকা দিয়ে সাহায্য করিস, এত টাকা কোথায় পাস?

আতিকুল বললো, আপনারা আমাকে এভাবে আটকালেন কেনো? আর এভাবে ব্যবহার করছেন কেনো? 

আরো একজন আরো রেগে বললো, গ্রামে কি করে বেড়াচ্ছিস সব রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে। তোর একাধিক নোংরামির খবরও আছে আমাদের কাছে। 

আতিকুল বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। মানুষের জন্য এত নিবেদিতপ্রাণ হয়ে আজ এই তার প্রতিদান! অন্য আর একজন সিগারেট টেনে নিয়ে বললো, দুশো চারশো একে ওকে দিয়ে প্রশংসা কুড়াতে চাস? মানুষকে সাহায্য করার জন্য কি সমাজপতি নেই? ভালো হয়ে যা, নতুবা পা ভেঙে হাতে তুলে দেবো।

নত মস্তিষ্কে আতিকুল বাড়ি চলে এলো। মানুষকে নিয়ে কিছু করায় ভাটা পড়লো। ও কখনো ভাবেনি এভবে অপদস্থ হবে, বাধাপ্রাপ্ত হবে। বাড়ি এসে স্থির থাকতে পারছে না সে। সমাজ নিয়ে বাঁচতে হলে সমাজের অন্যান্য মানুষও যা যা করছে তাই তাই করতে হবে। ব্যতিক্রম কিছু করতে গেলেই বিরুদ্ধ স্রোতের বাধায় পড়তে হবে। সবার আবদার মেনে নিয়ে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আতিকুল বিয়ে করলো। তার বৌ তাকে বলে, আমি তোমার সব কাহিনি জানি, এখন থেকে হিসাব করে চলতে হবে।

আতিকুল কথা বলে না, ভাবে, আগে কি আমি বেহিসাবি ছিলাম?

প্রতিবেশিনীরা কেউ কেউ এসে বলেন, এবার যদি আতিক ভালো হয়!

ঘাড় ঘুরিয়ে আতিকুল প্রতিবেশিনীকে দেখে ভাবে, আগে তবে খারাপ ছিলাম?

আর এক প্রতিবেশিনী বলেন, বৌ টা শক্ত আছে, এবার যদি আতিক পথে ফেরে!

যারা সমালোচনা করছে প্রত্যেককেই আতিকুলকে ভালো করে চেনে। কিছু বলে না, শুধু ভাবে, আমি কি তবে বিয়ের আগে বিপথে ছিলাম?

বেতনের টাকা আতিকুলের বৌ আগেই মুষ্টিবদ্ধ করে। আতিকুল বলে, আমি তোমাকে সহযোগী ভেবেছিলাম, আমাকে তুমি প্রতিপক্ষ করেছো।

আতিকুলের বৌ বলে, ছন্নছাড়া মানুষকে কিভাবে মানুষ করতে হয় আমার জানা।

একথা শুনে আতিকুল স্তম্ভিত হয়ে যায়। মূর্খের সাথে কথা না বাড়িয়ে ভাবে, এত কাজ করলাম, বিনিময়ে ছন্নছাড়া উপাধি পেলাম?

আতিকুল নামের আত্মোৎসর্গকৃত হৃদয়ের মরণ হলো। এখন সে প্রতি মাসে শাড়ি কেনে গরীব-দুঃখীদের জন্য না, বৌ এর জন্য। শীতেও শীতের পোশাক কেনে, কিন্তু তা বৌ, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, শ্যালকের জন্য। পড়াশোনার জন্য টাকা দেয়, কিন্তু দুস্থ শিশুদের জন্য নয়, শ্যালিকার জন্য। টাকা ঠিকই ধার দেয়, কিন্তু গরীবদের ভ্যান কেনার জন্য নয়, কুটুমের ব্যবসায়ের জন্য। তার বৌ হেসে বলে, বিয়ের আগে টাকা ছয় নয় না করলে জীবন আরো সুন্দর হতো। টাকায় টাকায় হয়। আগে উদার হস্তে টাকা নষ্ট করেছো আর শত্রুর সংখ্যা বাড়িয়েছো।

আতিকুল চুপ থাকে। কথা বলেই না। একটা প্রসারিত হৃদয় প্রসারিতই থাকলো, কিন্তু সেই প্রসারিত হৃদয় থেকে সমাজ আর আলোকিত হতে পারলো না।