ফুলেশ্বরী স্মৃতি স্টেডিয়াম
কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)
"শোন ডাবু, বাবাদের কথায় রাগ করতে নেই।"
"রাগ করব না তো কি গালে চুমু খাব?"
"আহ! রেগে যাচ্ছিস কেন ? বাবারা ঐ রকমই। সন্তানের ভালর জন্যে অনেক কিছুই বলে থাকেন।"
"তাবলে এইভাবে? জানিস ফুলু, সবার সামনে আমাকে অপমান করল আজ। আমার কোন আত্মসন্মান নেই?"
"আত্মসন্মানে যখন এতটাই লেগেছে, তাহলে বাবাকে প্রমাণ করে দেখিয়ে দে যে, তুইও এই অপমানের যোগ্য জবাব দিতে জানিস।"
"মানে?"
"মানেটা ভীষণ পরিষ্কার। তুই বাবাকে দেখিয়ে দে যে, তুইও আজ থেকে স্বাধীন। মানে উনাদের মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচতে তুই শিখিস নি। নিজের পরিশ্রমে, রোজগারে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাস।"
"কথাটা মন্দ বলিস নি। তা কিভাবে হবে শুনি?""
"তোকে আজ থেকে বাবার প্রতি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে, স্বচেষ্টায় স্বাধীনভাবে রোজগার করা শিখতে হবে।"
"রোজগার? আজ থেকে?"
"হ্যাঁ, আজ থেকে।"
"কাজটা বেশ কঠিন রে।"
"ন্যাকা ফুসু! চুপ কর। অনেক হয়েছে। আমাকে ভালবাসিস যখন, তখন বিয়ে করে তো আমাকে খাওয়াবি না কি?"
"হ্যাঁ, তা তো খাওয়াতে হবে। সেটা কিভাবে হবে?"
"ও রে গাধা! তোকে বোঝানো যাবে না। এক কাজ কর, বিকেলে পুকুরপাড়ে আয়। সব বুঝিয়ে দেব।"
ফুলুর কথা শুনে ডাবু বেশ লজ্জা পেয়েছে বলে মনে হল। তবে কথাটা বেশ মনে ধরেছে।
ফুলু, ডাবু দুজনেই এবার বারো ক্লাস পাশ করেছে। ফুলু ছোট থেকেই স্বাধীন। স্বনির্ভর। লোকের বাড়ি কাজ করে।মায়ের সাথে হাত লাগায়। বাবা মারা যাবার পর থেকে নিজেও আয় করতে শিখে ভাইদের টানছে।
ডাবুর বাবা হকারি করে। তেমন আয় করে না। কোন রকমে চলে। সংসারে অভাব আছে।
উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করে পাশ করতেই ডাবুর বাবা বলেই দেয়, ডাবুর এবার থেকে পড়ার সব খরচ ওকে নিজেকে ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া ওকে এখন থেকে রোজগার করতে হবে। বাবার উপর ভরসা না করে যেন চলে। এক কথায় বাবার অধীন যেন সে না থাকে।
তাতেই ডাবুর মটকা গেছে গরম হয়ে। পুকুরপাড় থেকে ফিরে এসে কিছুটা মনের জোর পেয়েছে। ফুলঝুরি কিছু বুদ্ধি বাতলেছে।
আজ স্বাধীনতা দিবস। কলেজ মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে। দূর থেকে দেশাত্মবোধক গান ভেসে আসছে.....
"মুক্তির মন্দির সোপানতলে.......
........লেখা আছে......
কত বিপ্লবী বন্ধুর.......
....... ........ ........ "
ডাবলু মাঠে রুটি, ঘুগনী, ডিমটোস্টের স্টল দিয়েছে। সকাল থেকেই দোকানে কাস্টমারের ভিড় উপচে পড়ছে। ওর দম ফেলার একদম সময় নেই। ব্যবসার কিছু টাকা ফুলঝুরি দিয়েছে ধার হিসেবে।
সন্ধ্যের পর ডাবলু ছলছল চোখে গুণে দেখল সে আজ সাতশ টাকা আয় করেছে। জীবনের প্রথম রোজগার। স্বাদই আলাদা। মনটা তাই একটু ফুরফুরে। নিজেকে পর নির্ভরশীল আর ভাবছে না। সবটাই ফুলঝুরির ক্রেডিট।
বাইরে মাইকে নজরুলের কবিতা পাঠ হচ্ছে আর ডাবলুর বুকের ভিসুভিয়াস যেন লাভা উদগীরণ করে চলেছে......... .......।
"বল বীর
চির উন্নত মম শির....
........... হিমাদ্রির......"
শির উঁচু করে ডাবলু ফুলঝুরির ঘরে ঢুকল। এক হাতে চিকেন চাওমিনের প্যাকেট। অন্য হাতে তেরাঙ্গা।
ফুলঝুরির জ্বর। অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ডাবলুর চোখে বেয়ে নামছে শ্রাবণ পূর্ণিমার ভরা কোটাল। । চাওয়ের প্যাকেট রেখে ওর মাথাতে পরম মমতায়, আদরে হাত বোলাল।
********* ***********
দেখতে দেখতে ছাব্বিশটা পনেরোই আগষ্ট কেটেছে.....
আজ আবার স্বাধীনতা দিবস।
দেবানুজ রায় আজ মস্ত বড় বিজনেসম্যান। ওর আণ্ডারে প্রচুর লোক কাজ করছে। সবাই সৎ, স্বাধীনভাবে উপার্জন করছে। মাথা উঁচু করে।
কলেজ মাঠে আজ একটা স্টেডিয়াম উদ্বোধন করতে এসেছে। স্টেডিয়ামের নামটাও বেশ ঝলমলে, "ফুলেশ্বরী স্মৃতি স্টেডিয়াম"।
ফুলু মানে ফুলেশ্বরী নার্ভের জটিল রোগে বহু দিন আগে মারা গেছে। তবু ভালবাসা বেঁচে আছে। স্বাধীনভাবে।
এই মাঠ থেকেই স্বাধীনভাবে পথ চলা শুরু করেছিল। সেই মাঠকেই নিজের ভালবাসার আদরে ভরিয়ে দিল ডাবলু ।
দেবানুজের চোখে শরতের শিশির পশ্চিমীঝঞ্ঝার মেঘ হয়ে জমছে। নামছে দু গাল বেয়ে।
মাইকে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে নজরুলের "বিদ্রোহী " কবিতাটি.....
".......আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত
......বেদুইন......"
Address: 85, Kalibari Road, Nalta
Near Air Port Auto Stand
PO: Italgachha
Kolkata -28
North 24 Parganas
No comments:
Post a Comment