Friday, July 15, 2022

গল্প || চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জী




নির্ভরতা

চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জী

                         (১)

বেশ কিছুক্ষণ হলো বাসস্টপে আমি দাঁড়িয়ে।বাবিনের স্কুলবাসের  অপেক্ষায়। কখন যে আসবে। আর ভালো লাগছে না। স্কুল বাসটা নির্দিষ্ট সময়ের থেকে একটু দেরি করলেই বুকের  ভেতরটা কেমন যেন ধড়াস ধড়াস করে। আজ তো দুটো বেজে গেল। কই এখনো তো হলুদ স্কুল বাসটা এলো না। সাথে অবিনাশও পাল্লা দিয়ে ফোন করে চলেছে। ছেলে অন্ত প্রাণ সে। দুটো বাজার সাথে সাথে ফোন আসবেই আসবে। ছেলে স্কুল থেকে ফিরল কি না।আজই তো বাবিনের স্কুলে লাস্ট ওয়ার্কিং ডে। আগামী কাল থেকে পুজোর ছুটি পড়ে যাচ্ছে।  ঘড়িতে বার বার সময়টা দেখছি।।এর মধ্যে তিন বার অবিনাশের ফোন চলে এসেছে। প্রতিবার একই উত্তর আমাকে দিতে হচ্ছে। ওই তো বাসটা দেখা যাচ্ছে। যাক্ বাবা, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। স্কুল বাস থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাবিন নামছে। এই স্টপেজে সে একাই নামে। 


--- টা টা ,  বাস কাকু। হ্যাপি পুজা।


--- টা টা, আদিত্য। ভালো করে পুজো কাটিয়ো।


স্কুল বাসটা কচিকাঁচাদের কলরবে একদম জমজমাট। পুজোর ছুটি বলে কথা।

--- বাবিন, আজ তো লাস্ট ওয়ার্কিং ডে ছিল। কোনো টেস্ট কপি দিয়েছে কি?


-- হ্যা, মা।  ম্যাথ কপি দিয়েছে ।


--- কত পেলি?


--- টোয়েন্টি। আউট অফ টোয়েন্টি ফাইভ।


--- টোয়েন্টি!!! পাঁচ নম্বর কোথায় কাটল?

 তোকে এত পড়িয়েও , এই অবস্থা। তোকে নিয়ে আর পারিনা।


--- টোয়েন্টি তো পেলাম। তুমি তাতেও হ্যাপি না।


--- ওই টোয়েন্টি নিয়েই খুশি থাক্।


--- প্লিজ, আজকে কিন্তু সন্ধেবেলা পড়াতে বসাবে না। দিম্মা বলেছে আজ চতুর্থী। কাল পঞ্চমী। আজকে থেকে নো লেখাপড়া।দেখোনি আমাদের পাড়ায় দুগ্গা ঠাকুর এসে পড়েছে। চলো না মা, এখন একটু ঠাকুরটা দেখে আসি।


--- এখন যাব ঠাকুর দেখতে?এখন চান, খাওয়া সব বাকি!


--- প্লীজ ,প্লীজ। চলো না মা।


আমার সারাটা সকাল , দুপুর, সন্ধ্যে ও রাত ছেলেকে ঘিরেই কাটে। আমার সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত---পুরোটাই বাবিনকে দেওয়া।ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বাবিনের স্কুলের টিফিন তৈরি করা,  ছেলেকে ঘুম ঘুম চোখে দু গাল ভাত খাইয়ে দেওয়া। তার পর ছুটে ছুটে ছেলেকে নিয়ে বাসস্টপে পৌঁছানো। সত্যি কথা বলতে আমার টাইম ম্যানেজমেন্ট  কিন্তু যথেষ্ট নিখুঁত।বাবিন এতদিন স্কুলে পড়ছে, আজ পর্যন্ত একদিনও সে স্কুল বাস মিস করেনি।বাবিনের স্কুলে চলে যাওয়ার পর আমার শুরু হয় ঘরকন্নার সমস্ত কাজ। বছরের আদ্ধেকের বেশি সময় তো অবিনাশ কলকাতার বাইরে বাইরেই কাটায়।সে এখনো অফিস ট্যুরেই ব্যস্ত । পুজো তো প্রায় দোরগোড়ায়। সবাই মায়ের আসার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে।পাড়ায় পাড়ায় আলোর রোশনাই। বাড়ি ফেরার পথে দুগ্গা ঠাকুরকে দেখে বাবিনের মন খুব খুশি। ঠাকুর দেখে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বাড়ি চলে এল। খেয়ে দেয়ে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।বিকেলে ওকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো। এখনো পাড়ার মন্ডপে কিছু কাজ চলছে। ওগুলো দেখতেই বাবিনের আনন্দ, কি যে আনন্দ পায় কে জানে! সাথে আবার আমাকেও থাকতে হবে। আলমারি থেকে পুজোর জন্য কেনা জামা কাপড় গুলো বের করলাম। শাড়িগুলোর পাশে পাশে   ম্যাচিং করা জুয়েলারী গুলো রেখে দেখতে লাগলাম। পুজো আসলে সেই যেন শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যাই। ছোট্টবেলার মনটা ময়ূরের মত পেখম তুলে আনন্দে নাচতে থাকে। চারিপাশে শিউলি ফুলের মনমাতানো সুবাস। শরৎ কালের নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের ভেলা।


আজ অষ্টমী। সকালে অবিনাশ দিল্লি থেকে ফিরেছে। আমি বাবিনকে নিয়ে পাড়ার পুজো মন্ডপে অঞ্জলি দিতে এলাম। অবিনাশের বরাবরই অঞ্জলি দিতে অনাসক্তি।তার ওপর আজ সকালে বড্ড ক্লান্ত। একটা লম্বা ঘুম দিলেই একদম চাঙ্গা। আজ শুধু ঘুম আর ঘুম।


--- ও মা, আজ ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে তো?


অঞ্জলি দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতেই বাবিনের বায়না শুরু। উফ্! আর পারিনা আমি! একা হাতে সব সামলে। অবিনাশকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেচারা‌ আজ বড্ড ক্লান্ত। আর এদিকে ঠাকুর দেখার জন্য বায়না করছে বাবিন।বাবিনকে রঙিন পায়জামা পাঞ্জাবি পরে একেবারে ছোট কার্তিক ঠাকুরটি লাগছে।

মায়ের নজর যেন না লাগে।

--- ও মা, বলোনা, যাবে তো?


--- ওরে বাবা আগে তো বাড়ি যাই সোনা।


--- না, না। এখুনি বলো। সন্ধ্যে বেলায় যাবে তো?


--- আচ্ছা, আচ্ছা, নিয়ে যাব।


দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নিলাম। সারাটা দুপুর বাবিন অবিনাশের সাথে দস্যিপনা করে কাটায়। বাবাকে আর পায় কতটা সে! তাই যতটা সময় পায় সুদে আসলে সে মিটিয়ে নেয়।যাই হোক, সন্ধ্যেবেলায় আমি আর বাবিন সেজেগুজে  ঠাকুর দেখতে বেরোলাম। অবিনাশের ভিড় ভাট্টা পোষায় না। তাই সে এবেলাও বেরোলো না। আমার যে একটুও অভিমান হলো না, তা নয়।

কিন্তু কিছু করার নেই। অবিনাশ একটু এমনই। এত বছরে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছি। বাইরে বেরোতেই দেখলাম চারদিক আলোময়। রঙিন আলোয় ভাসছে সবকিছু। রাস্তায় বেশ ভীড়। অষ্টমীর সন্ধ্যেতে এমনিতেই ভীড় বেশি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভীড় ও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। শক্ত করে বাবিনের হাতটা চেপে ধরলাম।বাবিনও যথেষ্ঠ সাবধানী।জানে ভীড়ের মাঝে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেশ কিছুটা পথ  চলে এসেছি।বাবিনের বেশি চাহিদা নেই। একটু ফুচকা খেতে চাইল। আমরা দুজনে টক- ঝাল ফুচকা খেয়ে খুব খুশি। সামনের মন্ডপটায় প্রচন্ড ভিড়। প্রবল মানুষের চাপ। আবারও বাবিনের ছোট্ট হাতটা শক্ত করে ধরে নিলাম।এত ভিড়ে এগোনোটা বোধহয় ঠিক হবে না। ফিরেই যাবো, ঠিক করলাম। কিন্তু ততক্ষণে একটা ভিড়ের বড় ঢেউ এসে সবকিছু ছাপিয়ে গেল। আমার মুঠো থেকে ছোট্ট বাবিনের ছোট্ট হাতটা গলে বেরিয়ে গেল।আমি পাগলের মতন দিশেহারা হয়ে বাবিনকে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম। কোথায় ছিটকে গেল আমার বাবিন? দুচোখে অঝোর ধারায় নেমে এলো বর্ষা । মাথা আর কাজ করছিল না।বাবিনের মুখটা  বারবার শুধু মনে পড়ছে।আশে পাশে কোথাও তার চিহ্ন মাত্র নেই। শুধু অচেনা কালো মাথার ভিড়। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোর মাঝে বাবিনকে খুঁজে চলেছি। হঠাৎ করে মাথায় এল কর্ম কর্তাদের কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা। কোনোরকমে দৌড়ে পৌঁছে গেলাম মঞ্চের কাছে।


---- " বাবিন, তোমার মা, শ্রীমতি রঞ্জাবতী স্যানাল তোমায় খুঁজছে। তুমি যেখানেই থাকো , আমাদের মঞ্চের কাছে চলে এসো।তোমার মা এখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।" 


মন শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম।ব্যাকুল‌ নয়নে বাবিনের ফেরার পথ দেখছি।প্রতি টা মূহূর্ত মনে হতে লাগল এক একটা শতাব্দী। তার ই মাঝে বাবিনের কান্নার আওয়াজ। সাথে "মা"  বলে ডুকরে কেঁদে ওঠা। দুজন অল্প বয়সী ছেলে বাবিনকে খুঁজে পেয়ে নিয়ে এসেছে। হুড়মুড় করে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার সোনা মানিক। আমার পৃথিবী ফিরে পেলাম। বাবিনের কান্না ভেজা চোখে এক গভীর নির্ভরতার প্রকাশ।এ হাত সারাটা জীবন যত্ন করে ধরে রাখব আমি।


                        (২)


সানাইয়ের সুর বাজছে মাইকে। কিন্তু কিছু ভালো লাগছে না আমার। একটু আগে কত আনন্দ ছিল মনে।বেশ কিছু দিন পর  আমরা আজ একসাথে বাইরে বেরিয়েছিলাম  ঠাকুর দেখবো বলে। কেন‌ ‌‌যে  হাতটা ছাড়তে গেল মা। মায়ের বয়স হয়েছে।এখন আর বাইরে বেরোতে চান না। যতটা না বেরোলেই নয়। মহাষ্টমীর দিনটাতেই আমার ছুটি।অন্য দিনগুলোতে তো হসপিটালে ডিউটি থাকে। মায়ের ঠাকুর দেখার খুব ইচ্ছে। কিন্তু বয়সের ভারে সব ইচ্ছে গুলো উড়ে গেছে।জোর করেই একটু মাকে 'মায়ের" দর্শন করাতে নিয়ে আসা। প্রণাম করেই বাড়ি ফিরে যেতাম। কিন্তু এখন এই বিপত্তি। এখানে মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথায় যে গেলো মা। মা সাথে তো মোবাইলটাও রাখে না। মনে পড়ে গেল সেই ছোট্ট বেলার এক স্মৃতি।


--- "রঞ্জাবতী স্যানাল, আপনার ছেলে আদিত্য আপনার জন্য আমাদের এই মঞ্চে অপেক্ষা করছে।আপনি  যেখানেই থাকুন, এখানে চলে আসুন।"


কুড়ি মিনিটের অপেক্ষা যেন যুগ যুগান্তরের অপেক্ষা বলে মনে হচ্ছিল আমার।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। হঠাৎ পিঠে হাত। খুব চেনা স্পর্শ। মায়ের স্পর্শ।

কর্ম কর্তাদের ক'জন অশক্ত রণ্জাবতী কে ধরে ধরে  যত্ন করে নিয়ে এলো।


--- "কিরে বাবিন, কোথায় ছিলি তুই ? "

 রঞ্জাবতীর চোখ ভীত, সন্ত্রস্ত।


---" মা, এবার শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রাখবে। একদম ছাড়বে না। ছোটবেলায় যে ভাবে  আমি তোমার হাতটা ধরে রাখতাম, ঠিক সেভাবে তুমি আমার হাতটা ধরে রাখো।‌কোন ভয় নেই, আমি আছি তো!

আমি দৃঢ় , বলিষ্ঠ হাতে মায়ের কাঁপা, কাঁপা হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করলাম। রঞ্জাবতীর ‌চোখে তখন পরম নির্ভরতার প্রকাশ।।




3, Ramlal Bazar road
Post office Haltu
Kolkata 78



No comments:

Post a Comment