ব্রজেনের মা
স্বপন মণ্ডল
মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না। সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। লোকের বাড়ি ভাড়াভেনে, ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না। সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। লোকের বাড়ি ভাড়াভেনে, ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না। সময় পূর্ব-পাকিস্তানের পাইকগাছা, আসাসুনি, দাকোপ, সাতক্ষীরার মানুষ কালিন্দী পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেবখালি-যোগেশগঞ্জে ঢুকে পড়ে দলে দলে। প্রতি রাতে বিশ-পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার। লুকিয়ে চুরিয়ে জীবন হাতে নিয়ে এপারের মাটি ছোঁই তারা। হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদ হয়ে বাসন্তী-গোসাবার দিকে এগিয়ে আসে। বাঁচার তাগিদে রায়মঙ্গল-কলাগাছির ঢেউও তুচ্ছ জ্ঞান করে। প্রাণকিশোরের পরিবারের সঙ্গে ব্রজেনের মা যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ এবং ব্রজেনের বয়স সাত। ওর স্বামী নিত্যানন্দ ছেলে বউকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে পারেনি। ব্রজেনের মা সাহেবখালির পারে মৃধাবাড়ির গোয়াল ঘরে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করে। কিন্তু নিত্যানন্দর দেখা পায়নি আর। কেন এল না মানুষটা জানতে পারেনি তা-ও। দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সঙ্গীদের সঙ্গে সাতজেলিয়া দ্বীপে আসতে বাধ্য হয়। তারপর এক জোতদারের ঘরের কানাচে একচালা কামরা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। পয়সাকড়ি কাছে ছিল না কিছুই। লোকের বাড়ি ভাড়াভেনে, ধান সেদ্ধ করে পেটের ভাত জোগাত। কিছুদিন পরে খবর আসে ওর স্বামী নিত্যানন্দ রাজাকারের গুলিতে মরেছে। দিশাহারা হয়ে বসে থাকে ক’দিন। তারপর মোড়লের বউয়ের কথায় ভরসা পায়। ঠোঁট কামড়ে উঠে পড়ে লাগে ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য। কিন্তু ভরা যুবতী শরীর এবং পুরুষ্টু চেহারা ওর কাল হয়। প্রথম দিকে ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে লুকোতে চেয়েছিল নিজেকে। নিজের নাম, পরিচয় সব হারিয়ে সে শুধু ব্রজেনের মা হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। জোতদার মোড়লরা দিনে এক আর রাতে আর এক। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। অধর মোড়লের বউয়ের কাছে একখানা সায়া-ব্লাউজ চেয়েছিল ব্রজেনের মা। ফিনফিনে থান কাপড়ে শরীর ঢাকে না যে। কিন্তু বর্ষা-শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এলেও সায়া-ব্লাউজ জোটেনি। গোটা দুই থান কাপড়ে বছর কেটে যেত তার। নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালি দিত অনেকেই। কিন্তু সত্তরের দশকের সময়টা এমনই, আবাদি সুন্দরবনে খাওয়া-পরা জুটতো না অধিকাংশ ঘরে। কে দেবে কাকে পোশাক। পৌষ মাসে ধান উঠে গেলে সারাদিন মাঠের গরুদের সঙ্গে দিন কাটতো ব্রজেনের মায়ের। গোবর কুড়াতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ঢুকতো চুপিচুপি। কিন্তু তাতেও রেহাই হত না। আবাদে জোতদারের আধিপত্য এবং লোভ নায়েব-জমিদারের থেকে কম ছিল না। সত্তরের দশকেও হুজুর-ভগবান ছিল তারাই। বিকল্প পথ খোঁজে ব্রজেনের মা। যে কেউ একজন বিয়ে করে স্বীকৃতি দিলে বেঁচে যায় সে। হাটকুড়ো, দোজবর—কিছুতেই আপত্তি ছিল না। কিন্তু নাবালক ছেলেসহ বিধবাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে এমন সাহসী পুরুষ সুলভ ছিল না।
নিমাই সরদার রাঁচির মানুষ। মুন্ডা সম্প্রদায়। তাগড়াই চেহারা এবং গায়ের শক্তির জন্য খাতির ছিল সব মোড়লের কাছে। ষাট কেজির ধানের বস্তা একা একাই কাঁধে তুলতে পারত। ফসলের বোঝা মাথায় নিত সবার থেকে বড়ো। নিমাইয়ের হাঁটা চলায় এই গৌরব ঠিকরে পড়তো সব সময়। ব্রজেনের মায়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয় রক্তখালির মাঠে। পান্তার হাঁড়ি মাথায় নিয়ে ব্রজেনের মা সাত সকালে আলের উপর এসে দাঁড়ায়। লাঙল ছেড়ে নিমাই এগিয়ে যায় হাঁড়ি নামিয়ে নিতে। আষাঢ় মাসে প্রথম সকালের রোদ জেল্লা দিচ্ছিল খুব। নিমাই ব্রজেনের মায়ের অনাবৃত বাহুযুগল থেকে চোখ সরাতে পারেনি। এরপর এক সন্ধ্যায় মোড়লবাড়ির গোয়াল ঘরে গরু বাঁধতে গিয়েছিল নিমাই। ব্রজেনের মা হঠাৎই তার হাত চেপে ধরে। কী কথা বলেছিল তা জানা যায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা একজন দেখে ফেলতে পাঁচ কান হয়। বর্ষার কাজের মরসুম শেষ হতে নিমাইয়ের কাছে কৈফিয়ৎ চায় মোড়ল। নিমাই বলেছিল, সে বিয়ে করতে চায় ব্রজেনের মা’কে। বিষয়টি বিচার সালিশী পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু দশের বিচারে অপমান ছাড়া কিছুই জোটেনি। আদিবাসী নিমাই পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে পারে না। সমাজের জাত যাবে। বিচারসভার রায়ে ব্রজেনের মা’কে পাড়াছাড়া হতে হয়। দয়াবশত চুনকালি মাখানো হয়নি মুখে। তবে বিশ-পঞ্চাশটা চোখ একসঙ্গে ঘেন্না ছুঁড়ে দিয়েছিল তার দিকে। পাড়ার মেয়েরা বলে, ‘‘শরীলির জ্বালায় জাত-ধর্ম হারিয়ে ফিলেছে মাগি! ছাবালডার কথাও ভাবল না! দূর দূর ঝাঁটার বাড়ি তোর মুখে।” মাইনের ধান থেকে দু’মন কাটা যায় নিমাইয়ের।
পৌষ মাসের শেষে বনবিবি প্রতিমার চক্ষুদান করছিল শিবপুটো। পয়লা মাঘ বনবিবির হাজত। সন্ধ্যা নামতে ঠাণ্ডা পড়েছে জমিয়ে। শিবপুটো কাঁথাটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। টেমিটা দেলকোর উপর বসিয়ে তুলিতে রঙ লাগায়। তারপর কিছুক্ষণের জন্য দম বন্ধ হয়। শরীরের সব কম্পন থামিয়ে ফুটিয়ে তোলে দেবীচোখ। দম ছেড়ে সোজা হয়ে বসতে যাচ্ছিল। এর মধ্যে খড়ের গাদার একপাশে কিছু একটা খড়মড় শব্দ হতে ফিরে তাকায়। দেখে অন্ধকারের মধ্যে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে ব্রজেনের মা। এগিয়ে এসে বলে, ‘‘বনবিবির শরীলি অত জেল্লা দিয়ো না ঠাকুরপো। যত জেল্লা তত জ্বালা।” শিব চৌকি এগিয়ে দেয় বসতে। ব্রজেনের মা বলে,
‘‘এট্টা বিধান নেব বলে তোমার কাছে আইচি ঠাকুরপো। নিমাই আমারে নে পালাতি চাচ্ছে শওরে। কী করব?’’
শিবপুটো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “ছেলেটার কী হবে?’’ ব্রজেনের মা বলেছিল,
“আমি বাঁচলিও ব্রজেন গরুর রাখাল, মরলিও গরুর রাখাল। না খেয়ে তো মরবে না।”
শিবপুটো পাঁচালি সুর খেলিয়ে বলে ওঠে,
“দয়ার মা বনবিবি বনের মাঝারে, মুসকিলে পড়িয়া ডেকো মা বলিয়া তারে”।
ব্রজেনের মা খড়ের গাদার গায়ে শরীর সেঁটে দিয়ে বলে, ‘‘বনের বাঘ বনবিবি মায়ের কথা শুনতি পারে ঠাকুরপো, কিন্তু শওরের বাঘ কি শোনে?’’
চক্ষুদান হওয়ার পর প্রতিমার শরীরে আবরণ দরকার হয়ে পড়েছে। ঘাড়ের গামছাটা বনবিবির শরীরে ফেলে দেয় শিবপুটো। রঙের খুলিতে তুলি ঘোরাতে ঘোরাতে কিছু ভাবছিল সে। ব্রজেনের মা বলল,
‘‘যদি বাঁচি, সারাজেবন তোমারে ভগবান মানব ঠাকুরপো। আমার ছেলেডারে দিখো এট্টু।’’
শিবপুটো কোনো উত্তর করেনি। বাম হাতের তালুর পিঠে তুলি ঠুকে রঙের গতি সামলে নেয়। তারপর বনবিবির কোলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুখের চক্ষু দান করে। মুখ না ফিরিয়ে শিবপুটো বলে,
‘‘দুখে বনবিবির দয়া পেয়ে রাজা হয়েছিল জানো তো?’’
পিছন থেকে কোনও উত্তর আসেনি। শিবপুটো তাকিয়ে দেখে ব্রজেনের মা চলে গেছে। সেই রাতে সারারাত ঘুম পাড়াতে পারেনি সে। অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্তে আসে, ব্রজেনের মায়ের পালিয়ে যাওয়াই ভাল।
সকালের কুয়াশা সরে যেতেই শীতের রোদ উজ্জ্বল হয়। কপিখেতের পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছিল শিবপুটো। এই সময় খেয়াঘাটের দিক থেকে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসে দীননাথ। খানিকটা দম নিয়ে বলতে শুরু করে নিমাই এবং ব্রজেনের মায়ের পরিণতির কথা। গভীর রাতে কলোনিপাড়ার নদীচরে নেমে যায় ব্রজেনের মা। দত্ত নদীর ওপার থেকে নৌকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল নিমাই। চাঁদনি রাতে সেই নৌকা মাঝনদীতে দিশাহীনভাবে ঘুরপাক খায় স্রোতে। তারপর শেষভাটায় নৌকা ছেড়ে উঠে যায় ওরা। ব্রজেনের মা’কে সায়া-ব্লাউজ আর রঙীন কাপড় পরিয়ে খোপায় ফুল গেঁথে দেয় নিমাই। তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিল কোথাও। কিন্তু সব প্রস্তুতি নিয়েও কোথায় যে তাদের বাধলো সে কথা জানে না দীননাথ। নিজে চোখে দেখে এসেছে ঘরের দরজার মুখে গ্যাঁজলা উঠে মরে পড়ে আছে নিমাই আর ব্রজেনের মা। কৌতূহলী মানুষ এগিয়ে যাচ্ছিল খেয়াঘাটের দিকে দলে দলে। কলসি কাঁখে জল আনতে যাওয়া মেয়ে বউরা ছি ছি করতে করতে মুখে কাপড় চাপা দেয়। মোড়লেরা বলে, ‘‘ঘোর কলি, ঘোর কলিকাল!’’ শিবপুটো ধীর পায়ে উঠে গিয়েছিল প্রতিমার কাছে। শাড়ি ব্লাউজ এঁকে দিয়েছিল বনবিবির শরীরে। তারপর জোড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুখেকে মনের মতো করে সাজিয়ে বলেছিল, ‘‘ব্রজেন, তোমার মা’কে ভুল বুঝো না।’’
Bakul Apartment, 18/2, Kalikapur, Kolkata-99, Mobile-9674315968
No comments:
Post a Comment