শেষ পর্ব
নিরন্ন
প্রীতম ঘোষ
এরপর দীপেন তার এই দীর্ঘকাল যাবৎ প্রিয় বন্ধুর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে থাকার কারণ সহ নিজের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করতে থাকে - " কলেজ এ ফাইনাল ইয়ার এ পরীক্ষার পর তুই তো ইন্টার্নশিপ করতে চলে গেলি , আমি তখনও কিছু কাজের খোঁজ পাই নি , ইন্টার্নশিপেও আমার সিলেকশন হলো না সেটা তুই জানতিস, তারপর একটা বেঙ্গালুরু বেসড আই -টি কোম্পানির খোঁজ পেলাম সেখানে নিয়োগ চলছিল , পরীক্ষা দিলাম , ভাগ্যক্রমে পরীক্ষায় পাসও করে যাই, ইন্টারভিউ দিই আর সিলেক্টও করে নেয় আমাকে, তিন লাখ টাকার প্যাকেজ লাগে আমার , আর এখন সেখানেই চাকরি করছি। এরই মাঝে একদিন সল্টলেক যাবার পথে বাসে আমার পকেট মেরে নেওয়া হয় ফলে আমার মহামূল্যবান মুঠোফোনটি চুরি যায় সঙ্গে আমার ওয়ালেট ও ব্যাঙ্ক থেকে সদ্য ইস্যু হওয়া ক্রেডিট কার্ডটিও খোয়া যায়। এই সব চক্করে বেশকিছুদিন আমার সময় নষ্ট হয় সব কন্টাক্ট হারিয়ে যায় , খুব কষ্ট করে কিছু সামান্য পয়সা জোগাড় করে আমি আবার একটা ফোন কিনি কিন্তু সেটা আবার স্মার্টফোন ছিল না ফলে যে তোর সাথে সোসিয়াল মিডিয়া মারফত যোগাযোগ রাখব সেটাও হয় নি , পরে প্রথম স্যালারি হলে আবার নতুন একটা স্মার্টফোন কিনি , এভাবে তোর সাথে যোগাযোগ হারিয়ে যায়। আর আমার শরীর গতিক বেশ ভালই আছে দেখতেই তো পাচ্ছিস দিন দিন ফুলে ঢোল হয়ে যাচ্ছি , কি ছিলাম আর কি হলাম এখন ", বলে সে হাসতে থাকে । এরপর বলে ওঠে -" আর বাবা মার কথা বলতে ওরা ভালই আছেন ভগবানের কৃপায় তেমন কোনো সমস্যা নেই ওদের নিয়ে বুঝলি" , আচ্ছা আমার তো বৃত্তান্ত তো হলো এবার তোর ঝুলিটা খোল দেখি "। অতীশ বলে ওঠে - " আমার ওই চলছে বুঝলি .. চলছে.. " তার বিষন্ন উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে দীপেন বুঝল যে অতীশ কিছু একটা লোকাচ্ছে তাই সে বলে ওঠে - " চলছে মানে ? চলছে আবার কি ? এই ! তোর কি হয়েছে বলত ? এসেথেকেই দেখছি তুই কিরম মনমরা একটা হয়ে আছিস , কিছু দুশ্চিন্তা করছিস মনে হচ্ছে ? কেসটা কি বলত ? " দীপেন এর কথা শুনে চা ওয়ালা বলে ওঠে - "দেখো না দাদা আমিও তখন জিজ্ঞেস করলাম কিছুই তো বলছে না অতীশদা , ও অতীশ দা ! শুনছো নাকি ? আরে ! " অতীশ বলে - " আজ আসি বুঝলি " এবং সেখান থেকে দ্রুতপদে বাড়ির দিকে রওনা দেয় । দীপেন এর ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধার ঠেকে না ফলে সে বন্ধুর পিছু নেয়। পিছু ধাওয়া করে সে দেখে যে অতীশ বাড়ি না ফিরে পাশের গলিতে ঢুকে যায় সেখানে সে কাউকে ফোন করে খুব কাকুতি মিনতি করতে থাকে , একটু কাছাকাছি এসে আড়িপেতে সবটা শোনে দীপেন , বন্ধুর চাকরি গেছে শুনে সেও ভীষণ অবসন্ন হয়ে যায় , কিন্তু সে যে ব্যাপারটি জেনে গেছে সেটা বন্ধুর থেকে গোপন রাখবার জন্য সে সন্তর্পনে সেখান থেকে পালায় ।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে যায় , আবার দুই বন্ধুর দেখা হয় , এবার অতীশ আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়ে গেছে , তার শরীর ভাঙতে শুরু করেছে , দীপেন এবার আর চুপ থাকে না , সে সবকিছু এবার অতীশ কে খুলে বলে , সে তাকে অর্থ সাহায্য করারও প্রস্তাব ও দেয় এবং বলে তার অনেক এরকম কর্পোরেট সংস্থা এর লোকেদের সঙ্গে ওঠা বসা আছে , তাই সে তাকে কে নতুন চাকরি খুঁজে দেবার বিষয়েও সাহায্য করতে পারে , এসব শুনে অতীশ একটু আশ্বস্ত হয় এবং বলে ওঠে - " টাকা আমার লাগবে না ,ওপরের দয়ায় বেচেঁ থাকতে আমি শিখিনি , চাকরির ব্যাপারটা একটু দেখিস পারলে ওতেই অনেক , বাকি আমিও চেষ্টায় আছি দেখি কি হয় " । কথাটা শুনে দীপেন বলে - " দেখ ভাই কিছু মনে করিস না কিন্তু একটা সত্যি কথা বলতো - তোর ঠিক কতটা সামর্থ্য এই মুহূর্তে ? কাকিমার অসুস্থ্যতা , কাকুর পেনশন আটকে গত দুবছর ধরে , তুই সামলে নিতে পারবি তো আদেও ? দেখ আমি তোর সেই ছেলেবেলার বন্ধু তাই বিপদের সময় তোর পাশে থাকা আমার কর্তব্যের মধ্যে পরে , অর্থসাহায্য লাগলে সেটা বলতে দ্বিধা করিস না প্লীজ ,দেখ আমি তোর উপর কোনো দয়া - দাক্ষিণ্য করছি না জাস্ট যেটা বন্ধু হিসাবে করা দরকার সেটা করতে চেষ্টা করছি ভাই এখানে বন্ধুত্বের মাঝে আত্মসম্মান টেনে এনে নিজের সঙ্গে নিজের অসুস্থ বাবা মায়ের কোনো বড়ো ক্ষতি ডেকে আনিস না ভাই , এটা তোর কাছে আমার অনুরোধ , কারণ তোর এই অযথা জেদের কারণে আমি চাই না যে কাকু - কাকিমা কষ্ট পান , ওনারা আমার নিজের মা - বাবার মত " ।
শুনে রাগে ফুঁসে উঠতে থাকে অতীশ সে দীপেন কে সাফ জানিয়ে দেয় অতিরিক্ত সহমর্মীতার দরকার নেই , সে নিজেরটা ঠিক নিজেই করে নিতে পারবে , আর তার বাবা মায়ের চিন্তা যেন দীপেন না করে , আর সে যেন তার সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখে ভবিষ্যৎ এ , আজ থেকে তাদের বন্ধুত্ত্ব শেষ , তার মুখ সে আর কোনো দিন দেখতে চায় না । এভাবে , দুজনেই পাড়ার মোড় থেকে দুদিকে চলে যায় , যথারীতি তারা আর কোনো যোগাযোগ করে না একে অপরের সাথে ।
মাস তিনেক এভাবে কেটে যায় , এরপর একদিন হঠাৎ একদিন আবার দীপেন লক্ষ্য করে অতীশকে তার চেহারা খুবই বিকট আকার ধারণ করেছে , মুখে একমুখ দাড়ি , গায়ে ময়লা জামা, নোনা ধরা একটা প্যান্ট পরনে , মুখচোখ দেখলেই বোঝা যায় শরীর ও মনের অবস্থা । এমনকি চঞ্চল এর কাছে চা টাও ধারে খেতে শুরু করেছে । এরপরই হটাৎ দেখাযায় অতীশ এর বাড়ির গলির দিকে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে , অতীশ তার পিছনে ছুট দেয় ব্যাপারটা কি অতীশ ছুটে চলে গেলে দীপেন এসে চঞ্চল কে জিজ্ঞেস করে , উত্তরে সে জানায় - " অবস্থা খুব খারাপ , গত দুমাস ধরে কাকু কাকিমা এর শরীর ভালো যাচ্ছিল না , কাকুর কাল রাতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল , আজ হসপিটালে ভর্তি করাতে হচ্ছে কন্ডিশন সিরিয়াস , কাকিমা হাই বিপি এর সুগার এর রুগী তারও দুবার মারাত্মক অবস্থা হয়েছিল দিন কয়েক আগে , তবে এখন মোটামুটি সুস্থ "। কথা গুলো শুনেই সেখান থেকে দীপেন ছুট দেয় অতীশ এর বাড়ীর দিকে , সে গিয়ে অতীশ এর বাবা কে অ্যাম্বুলেন্স এ তুলে দিতে সাহায্য করে , হসপিটাল এ সে তাকে অ্যাডমিট করায় ও তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করে । অতীশ এর মায়ের সাথে পরে কথা বলে এবং এও জানতে পারে যে শুধু যে তার চাকরি গেছে তাই নয় , চাকরি যাওয়ায় তার প্রেয়সী যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল কয়ের দিনের মধ্যে সেও নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে , ফলে সম্পূর্ন মেন্টাল ব্রেকডাউন এর একটা পর্যায়ে আছে অতীশ , পাগলের মত ব্যাবহার করে এখন, কোনো কাজ ঠিক করে করতে পারে না , স্নান খাওয়া পর্যন্ত করেনি কয়েক দিন , এদিকে আর্থিক অনটনে বাবা মায়ের উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তারা মৃতপ্রায় , তার চাকরির সব প্রচেষ্টা বর্তমানে বিফল এবং এখন সে প্রায় ভবঘুরে । দীপেন অতীশ কে সাহায্য করতে চাওয়ার পরও সে যে সাহায্য স্বীকার করেনি সেই কথাও অতীশ এর মাকে জানায় দীপেন , এও আশ্বাস দেয় যে সে এবার থেকে তাদের সকল সমস্যায় তাদের পাশে থাকবে এবং একটা কাগজে তার ফোন নম্বর টা লিখে দিয়ে যায় ও বিপদে আপদে তাকে যে কোনো সময় প্রয়োজনে ফোন করতে বলে । অতীশ একটু বাইরে ছিল এতক্ষন বাড়ি ফিরে দীপেন কে দেখে সে একটু আনন্দিত হলেও বিরক্ত ও হয় সমপরিমাণ এবং তার সাথে কোনো কথা না বলে সে উপরের ঘরে চলে যায় । পরে তার মা যখন তাকে দীপেন থেকে সাহায্য প্রত্যাখ্যানের কথা টা নিয়ে প্রশ্ন করে তখন সে অত্যন্ত রেগে যায় , এবং বলে - " আমার চাকরি নেই বলে পরের টাকায় খেতে - খাওয়াতে বলছ আমায় ! ছি ! তোমাদের লজ্জা করে না একটুও এগুলো ভাবতে ? ছোটবেলা থেকে কি শিক্ষা দিয়ে আমাকে মানুষ করেছ সব এক লহমায় ভুলে গেলে ? এখন পরের দয়ায় বেঁচে থাকার ইচ্ছা তোমাদের ! তোমাদের মা বাবা বলে মেনে নিতে আমার ঘেন্না করছে আজ ! " বলে সে চলে যায় । তার আত্মসম্মান এখন যেন পাহাড়প্রমাণ , পেটে অন্ন নেই , তাও মান সে খোয়াবে না , এই একরোখা মানুষিকতার জন্যে সে নিজে অভুক্ত থাকছে , মা বাবা কে অভুক্ত রাখছে তবুও তার কোনো চেতনার উদয় হচ্ছে না , বিপদে বন্ধুর সাহায্য তার কাছে ভিক্ষার সামিল ।
কয়েকদিন পর আবার সে চায়ের দোকানে অপেক্ষা করে দীপেন এর জন্য , তার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল বাবার অসুস্থতার সময় তার পাশে থাকার জন্যে ধন্যবাদ দেওয়া কিন্তু হলো উল্টো সে তার বাবার চিকিৎসার জন্য দীপেন এর দেওয়া পয়সা ফেরত দিতে এসেছে , এতে তাদের তুমুল ঝামেলা হয় এবং সেই দুজনের শেষ দেখা । পরদিন সকালে দীপেন ফ্লাইট ধরে বেঙ্গালুরু চলে যায় ও ডিউটি জইন করে , আর অতীশ তিলে তিলে শেষ হতে থাকে । সে চাকরি পাচ্ছেনা অনেকদিন বাবা এখন মৃত্যুশয্যায় , মা অসুস্থ , সবদিক থেকে বিদ্ধস্ত হয়ে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দায় তাই সে এবার তার যথসামান্য সঞ্চিত অর্থ দিয়ে জুয়া খেলতে থাকে , অল্পসময়ে বড়লোক হওয়ার নাকি এর থেকে ভালো কোনো আর পথ নেই তার মতে , সেখানে সে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ে , এমনকি জুয়ায় চিটিং করার মিথ্যা সন্ধেহে একদল মদ্যপ তাকে রাস্তায় গণপিটুনি দেয় , সেদিন শুধু মাত্র চঞ্চলের জন্য সে প্রাণে বেঁচে যায় । এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই তার বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে , তার মা সহ্যাগ্রস্ত হয়ে যায় । কোনো পয়সা না থাকায় সে এবার বাড়ির দামী জিনিসপত্র বেচে টাকা যোগাড় করতে থাকে , সবিকছু এমনকি মায়ের সোনার গহনা বেচেও শেষ পর্যন্ত মায়ের সঠিক চিকিৎসা করাতে পারে না সে এবং মাস কয়েকের মধ্যেই মাও দেহ রাখেন । এরপর হটাৎ অতীশ উধাও হয়ে যায় আর তার কোনো খোঁজ থাকে না , প্রথম দিকে সপ্তাহ খানেক তাকে গলির আশপাশে দেখতে পায় চঞ্চল কিন্তু তারপর আর তার খোঁজ মেলে না ।
এভাবে তিন বছর কেটে যায় , দীপেন এবার পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসে , চঞ্চলের কাছথেকে সব শুনে সে ভীষণ দুঃখিত হয় , নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর খারাপ সময়ে পাশে না থাকতে পারার জন্য। অতীশ নিখোঁজ শুনে সে চঞ্চল কে জিজ্ঞেস করে - " যা হয়েগেছে তাতো আর ঠিক করা সম্ভব না কিন্তু তোরা কেউ মিসিং ডাইরি করেছিস নাকি থানায় অতীশ এর খোঁজ করার জন্যে ? " উত্তরে চঞ্চল জানায় - " সবই করেছি , কিন্তু পুলিশের কাজ তো জানোই .. কি আর বলবো বলো , আমরা নিজেরাও উদ্যোগ করে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পেলাম আর কই তাকে "। এরম সময় হঠাৎ একটা ভিখারী এসে দীপেন এর গায়ে হাত দিয়ে ডাকে , জোড়হাত করে বলে - " ভগবানের নাম কিছু সাহায্য করুন বাবু , কাল থেকে কিছু খাইনি , নিরন্ন মানুষ বাবু , সাহায্য করলে ভগবান আপনাকে অনেক আশীর্বাদ করবে " , লোকটার মুখে একমুখ দাড়ি , কলিঝুলি জামা কাপড় ,একটা ময়লা লুঙ্গি ছেরা পরনে , উস্কখুস্ক চুল হতে লাঠি , কোমর ভেঙ্গেছে তাই ঝুঁকে হাঁটে সে । পাশ থেকে চঞ্চল বলে ওঠে - " ওকে পাত্তা দিয়ো না দাদা , মালটা রোজ এসে দোকানের সামনে ভ্যানতাড়া করে , চোর - ছ্যাচোড় যত্তসব ,সেদিন নরেন মুদির দোকান থেকে চাল চুরি করেছে সালা , পয়সা টা দেবে তুমি আর ঠিক পিছনে গিয়ে গাঁজা খাবে , সব নাটক এদের, তারাও তো মালটাকে "। এসব কথায় কান না দিয়ে পকেট থেকে দুটো খুচরো পয়সা বের করে লোকটার হতে দিতে গিয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো দীপেন , - "একি ! এযে অতীশ "!
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment