Friday, July 15, 2022

গল্প || সৌমেন দেবনাথ





পরার্থপরতা 

সৌমেন দেবনাথ 

মানুষকে চিনতে মানুষ ভুল করে না। যদিও মানুষের ভীড়ে মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কত রঙের মানুষ এই জীবধাত্রী ধরিত্রীর বুকে। যে যার কাছ থেকে প্রশংসা পাচ্ছে, তাকে সে মানুষ বলছে। যে যার সুখে-দুঃখে হাত বাড়াচ্ছে, সে তাকে মানুষ বলছে। আর যে যার কাছ থেকে একটু আঘাত পাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে, আশাতীত ব্যবহার পাচ্ছে না, তাকেই অমানুষের কাতারে ফেলে দিচ্ছে। সবাই চাইছে তাকে এসে কেউ প্রশংসা করুক, তার গুণকীর্তন করুক। কিন্তু মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হলো অন্যের নিয়ে সমালোচনা করা, অন্যের প্রতি হিংসা প্রকাশ করা, ঘৃণা করা। এই নেতিবাচক কাজগুলো আমরা সবাই করছি, আবার আমরা সবাই-ই চাইছি আমাদের স্তোব-স্তুতি করে না কেনো কেউ? আমায় সাবাস স্লোগান দেয় না কেনো কেউ? আমায় মাথায় তুলে রাখে না কেনো কেউ? নিজে যে আচরণ করি না, অন্যের কাছ থেকে সেইরূপ আচরণ প্রত্যাশা করা আমাদের যেন রক্তে মিশে আছে। নিজে কারো ভালো চাই না, অথচ মানুষ কেন আমার ভালো চায় না সেটা ভেবে চিন্তিত। মানুষের দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকি, আর আমার দোষ কেউ ধরলেই ভীষণ রকম চটে যাই।

আতিকুল খুবই পরোপকারী মানুষ। মানুষের জন্য কিছু করার প্রবল ইচ্ছা তার ভেতর রয়েছে। মানুষ হয়ে যদি মানুষের পাশেই না দাঁড়াতে পারলো তবে কিসের মানুষ! অন্যের কষ্টে ব্যথিত হয়, অন্যের অভাবে ভারাক্রান্ত হয়, অন্যের বিপদে জর্জরিত হয়। মানুষের পাশে দাঁড়ালে সেই মানুষই তাকে আবার সন্দেহ করে। মানুষকে সাহায্য করলে মানুষই তাকে বলে, অন্যের জন্য এত দরদ কিসের, নিজের চরকায় তেল দাও।

আতিকুল অবাক হয়ে যায় মানুষের এমন কথা শুনে। নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করতে গেলেও মানুষ অতি কথা শোনায়। কাউকে সাহায্য করলে মানুষ বলে, আপনি এত সাহায্য করেন কেনো? মানুষের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য খুব কাতর না? পরার্থে হাত প্রসারিত কোন স্বার্থে?

আতিকুল এমন অপ্রত্যাশিত শব্দ উচ্চারণ শুনে থমকে যায়। কাউকে সাহায্য করবে না, আবার কেউ সাহায্য করলে বাধা দেবে, এই হলো মানুষের স্বভাব। আতিকুলের আরো একটি স্বভাব আছে, যখন অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারে না, তখন উপদেশ দিয়ে সাহায্য করে। উপদেশ দিতে গেলেও সে বাধার সম্মুখীন হয়। কেউ বলে, আপনি উপদেশ দেওয়ার কে? পেটে নেই জ্ঞান, উপদেশের ঢিল ছোঁড়ে। জ্ঞান বিলাতে সবাই চায়, জ্ঞান নিতে কেউ চায় না। অথচ জ্ঞানের অভাবই সবার ভেতর বেশি।

এসব কথা শুনে আতিকুলের খুব খারাপ লাগে। কাজ করে, অথচ প্রশংসা পায় না। পরার্থে কাজের বিনিময়ে সে কিছু চায় না, কিন্তু মানুষ কেনো বাজে কথা শোনাবে! সমালোচনা শুনলে তার খুব খারাপ লাগে।

নিঃস্ব জেলেদের জাল কিনে দিয়েছে আতিকুল। অন্য জেলেরা তার উপর ক্ষিপ্ত হলো। ভালো কাজ করতে গেলেও মানুষ ভালো ভাবে নেয় না। যার প্রয়োজনে আসে, সেই শুধু একটু দুয়া করে দেয়, বাকিরা তাকে শত্রু ভাবে। ভালো কাজ যারাই করতে যায়, তাদের পিছনে মানুষ লাগে। কিন্তু ভালো কাজ করা যাদের নেশা, তারা এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে থেমে যায় না। কষ্ট পেলেও পরক্ষণে সে কষ্ট ভুলে যায়। মহৎ হৃদয়ের মানুষ ভালো কাজ করা থেকে কখনো পিছুপা হয় না। সে জানে খারাপ কাজ করলে যত না বাধা আসে, ভালো কাজ করলে তারচেয়ে বেশি বাধা আসে। ভালো কাজ করেছে বলে কত মানুষই সন্দেহের তালিকায় পড়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ভালো কাজ করে যারা তাদের সামনের মানুষ হাততালি দেয়, আর পিছনের মানুষ হাত ভেঙে দেয়।

আতিকুল একদিন সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষকের কাছে গেলো। স্যারকে জিজ্ঞাসা করলো, স্যার, ভালো কাজ করলে মানুষ ভালো না বলে মন্দ বলে কেন?

স্যার বললেন, ভালো কাজ মানুষ মৌসুম বুঝে করে। মৌসুম বুঝে ভালো কাজ করে যারা, তাদের কাজের পিছনে নিজস্ব উদ্দেশ্য থাকে। সারা বছর কাজ করলে মানুষ প্রশ্নিল চোখে তাকাবে না। 

আতিকুল স্যারের কাছ থেকে উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হলো। ভালো কাজ করার ধারাবাহিকতা যারা রক্ষা করে তারাই ভালো। লোক দেখানো ভালো কাজ করার মানুষ সমাজে বেশি বলেই সেসব ভালো কাজগুলোকে সমাজের মানুষ ভালো চোখে নেয় না।

এলাকার ছোট একটা প্রতিষ্ঠানে আতিকুল কাজ করে। সেখানেও সহকর্মীদের প্রয়োজনে অর্থ ধার দিয়ে সাহায্য করে। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোনো সহকর্মী অন্যায় করলেও তাকে আগে রক্ষা করে। এত কিছুর পরও যখন ঐসব সহকর্মীরা তাকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করে এবং সে অন্য কারো মাধ্যমে শুনতে পারে তখন তার ভীষণ রকম খারাপ লাগে। যায়-ই করতে যায় বুমেরাং হয়ে নিজেকেই বিদ্ধ করে। এই বিদ্ধতা সে সহ্য করতে পারে না। মানুষকে উপকার করে লাভ কি তবে? যাদের হিতার্থে কাজ করে সে, তারাই প্রতিহিংসাপরায়ণ।

বাড়ি এলে আব্বা বকেন। নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে বলেন। অন্যের জন্য কাজ করাকে নিরুৎসাহিত করেন। আব্বা অভিজ্ঞ মানুষ। তারপরও ভালো কাজে উৎসাহ না দিয়ে বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাবা বলেন, উপকার যে করে তার শত্রু বেশি। উপকারীকে বাঘে খায়। ইভটিজিং রুখতে গেলে তোর প্রাণও যেতে পারে। পক্ষ-পাতিপক্ষের দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে তুই দুই পক্ষেরই রোষানলে পড়বি। মানুষকে সাহায্য করার হৃদয় তোর আছে, চলতি পথে কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করবি কর, কিন্তু এই সাহায্য করার ব্যাপারটা ঘটিয়ে-রটিয়ে করিস না। ভালো কাজের কদর নেই, ভালো মানুষের দাম নেই। যত তুই ভালো ভালো উদ্যোগ নিবি, তুই তত ফাঁদে পড়বি।

আতিকুল থেমে যায়। কাজ করার স্পৃহা তার যেমন প্রবল, সমালোচনা সহ্য করার ধৈর্য তত নেই। হিতে যে বিপরীত ঘটবে, সেই বিপরীত সহ্য করার সামর্থ্য তার নেই। অপরিচিত মানুষ অনিষ্ট করলেও কষ্ট লাগে না, পরিচিত মানুষ বিনষ্ট চাইলে তার কষ্ট সহ্য করা যায় না। কিন্তু মানুষের স্বভাব বদলায় না, হোক সে বদ অভ্যাস, কিংবা ভালো অভ্যাস।

গ্রামে মধ্যবয়েসী এক বিধবাকে ছাগল কিনে দিয়েছে সে। একটি সেলাই মেশিন কিনে দিতেও সহয়তা করেছে। বিধবা মহিলা তাকে একবেলা রান্না করে খেতে দিয়েছে। ওমনি পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে গুঞ্জণ শোনা গেলো বিধবার সাথে তার সম্পর্ক। 

বিয়ে না করাটা ভালো কাজ করার পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ানোতে সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো। ছেলে বিয়ের জন্য রাজি শুনে আব্বা আম্মা খুশি হলেন। মেয়ে দেখতে গেলো। মেয়ে পছন্দ। মেয়ের আব্বার অনেক সম্পদ। বিয়েতে অনেক খরচ করবে জানতে পেরে আতিকুল বললো, বিয়ের অনুষ্ঠানমালা না করে সেই টাকা এতিম অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দিলে অনেক ভালো কাজ হবে।

একথা জানতে পেরে মেয়ের আব্বা যৎকিঞ্চিৎ চিন্তিত হলেন। তারপর মেয়ে জামাইকে কি কি দেবেন সবিস্তারে জানালেন। আতিকুল ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো, আমি কিছুই নেবো না। আমি মানুষের জন্য কাজ করি, আর আমি নেবো যৌতুক?

মেয়েপক্ষের সবাই আশ্চর্য হলেন। যে ছেলের চাহিদা নেই, সে ছেলে জীবনে বড় হতে পারবে না। যে ছেলে পাওয়া জিনিসও নেয় না, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল না। প্রাপ্তির আশা মানুষের স্বভাবজাত গুণ। সেই গুণ যার ভেতর অনুপস্থিত, তার ভেতর সমস্যা আছে, নতুবা মনস্তাত্ত্বিক ভাবে দেউলিয়া। বর্ণহীনভাবে যে ছেলে বিয়ে করতে চায়, তার জীবন বর্ণিল হবে না। আতিকুলের সাথে তাঁরা মেয়ে বিয়ে দিলেন না।

ফেরার পথে আব্বার সাথে আতিকুলের কথা হচ্ছে। আতিকুল বললো, দেখেছো আব্বা, সৎচিন্তার কোনো দামই নেই। সুস্থচিন্তা করলাম বলে অপমানিত হলাম।

আব্বা বললেন, তুই যে বোধ ধারণ করিস সেই বোধে সমাজ এখনো পৌঁছায়নি। আমি তোকে এই সুস্থচিন্তার শিক্ষা দেইনি, শিক্ষালয় তোকে এই সুস্থচিন্তার  শিক্ষা দেইনি, অথচ তুই সেই সুস্থচিন্তার ধারক। বোধ-বিবেক জাগ্রত না হলে এই সুস্থচিন্তা আসে না। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া তোর মত সন্তান পেয়েছি।

এভাবে দিন যায়, মাস আসে। বেতনের বড় একটা অংশ দুস্থদের মাঝে বিলিয়ে দেয় সে। কর্মের মধ্যেই প্রকৃত পরিচয়। চলার পথে গরীব-দুঃখী দেখলেই পকেট থেকে টাকা বের সহায়তা করে। গরীব-দুঃখী মানুষের মুখের হাসি দেখলে তার হৃদয়টা ভরে যায়। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সাধ্যমত অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। শীত মৌসুমে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ায়। বেকার যুবকদের ভ্যান কেনার টাকা ধার দেয়। গ্রামের এক ধনী লোক এসে বললেন, তুই কি গ্রামে ঋণের ব্যবসায় শুরু করবি? যাকে তাকে টাকা ধার দিয়ে লোভ দেখাচ্ছিস?

আতিকুল মাথা উঁচু করে লোকটার মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। ভালো কাজ করলেও ভিলেন হতে হয় সমাজের চোখে, সমাজের মানুষ এমন কেন? এমন আচরণ পেলে কাজ করার উদ্যমতা হারিয়ে যায়। 

গ্রামে এক রোগিনী আছেন। একটিই মেয়ে সন্তান থাকাতে সংসারে আয়-রোজগার নেই। মা মেয়ের কষ্ট প্রায়ই দেখে আতিকুল। উপকার করতে পারলে ওর ভীষণ ভালো লাগে। কোন দিন বাজার করে দেয়, কোন দিন ঔষুধ কিনে দেয়। এ কারণে ও বাড়িতে আতিকুলের আসা যাওয়া পড়ে। কিছু দিন পরেই গুঞ্জণ শোনা গেলো, আতিকুল রোগিনীর মেয়েকে পছন্দ করে। আতিকুল আকাশ থেকে পড়ে। ঘর থেকে বাইরে বের হতে ওর লজ্জা লাগে। চাচা এসে বললেন, ভাই, আতিকুলকে বিয়ে দিয়ে দাও। বিয়ে দিয়ে দিলে ছেলে ভালো হয়ে যাবে।

আব্বাও তার ভাইয়ের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলছেন। দুদিন বাদেই একদল মানুষ এলেন। আতিকুলকে দেখতে এসেছেন। ছেলে কি করে জানতে চাইলে পাশ থেকে এক প্রতিবেশিনী বললেন, দান করে।

কথাটি তিনি এত তুচ্ছতার সাথে বললেন যেন দান করা খারাপ কাজ। যাকে সাহায্য করা দরকার তাকে সাহায্য না করে যাকে সাহায্য করা দরকার না তাকে সাহায্য করলে আবার এসব শত্রু জন্মাতো না। মেয়েপক্ষের একজন বললেন, দান করা ভালো গুণ, সাহায্য করার অভ্যাস ভালো অভ্যাস, কিন্তু তার আগে তো স্বচ্ছল হতে হবে। 

আতিকুল বললো, স্বচ্ছল হওয়ার পর সাহায্যের হাত প্রসারিত করার চিন্তাটাও ভালো না। যে যেই অবস্থানে আছে সেখান থেকে মানব কল্যাণে কাজ করতে হবে। অল্প দিনের দুনিয়া, আজ আছি কাল নেই। আত্মচিন্তা বাদ দিয়ে আত্মনিবেদিত হতে হবে।

মেয়েপক্ষের মধ্যে একজন বিজ্ঞ আছেন। তিনি ভাবলেন, বিয়ের আগে ছেলেরা এমন উদারমনস্ক থাকে। কত কত সামাজিক কাজ করে। বিয়ের পর সংসারের চাকা টানতে থাকলে এসব উদারতা ছুটে যাবে। ছেলেটার মানসিকতা ভালো। 

এরপর মুখে উচ্চারণ করে তিনি বললেন, আমাদের মেয়ে ঢাকায় থেকে পড়ে। ঢাকায় তোমাকে চাকরি দিয়ে দেবো। তোমাকে ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে দেবো, পারলে কিছু টাকা তুমিও দিও।

আতিকুল একথা শুনে আশ্চর্য হলো। এত এত চাহিদা মেনে নিয়ে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। একটি চাহিদাও সুন্দর না। প্রসারিত হাত যার, প্রসারিত হৃদয় যার এমন অপ্রত্যাশিত আর অযাচিত কথা মেনে নেবে না সে। সে কোনো লোভী মাছ নয় যে, টোপ দেখলেই গিলবে। ওর মন সংকীর্ণ নয় যে, সুবিধা দেখলেই সিদ্ধান্ত বদলে নেবে। 

এ বিয়েটাও ভেঙে গেলো। মেয়েপক্ষের একজন বেশ শব্দ করেই বললেন, চাল নেই, চুলো নেই, দানশীল মহসীন! আয়ের গুণ নেই, ব্যয়ের গুণ আছে। দুশো চারশো দান করে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করা যায় না।

আব্বা আম্মার মুখের দিকে চেয়ে থেকে আতিকুল কেদে দেয়। আব্বা বলেন, তুই এত এত ভালো কাজ করছিস, কিন্তু তোর শুভাকাঙ্ক্ষী না বেড়ে কমছে, তোকে কেউ পছন্দ করছে না, এখন তুই ভাব তোর কি করা উচিত।

আম্মা বললেন, তোর দ্বারা কোনো বিঘ্ন ঘটবে না, কারো অপকার হবে না এটা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তোকে ঘর-সংসারও করতে হবে, তোর অর্থ-কড়ি ও দরকার। বলছি না, তুই অর্থ বিনষ্ট করিস, কিন্তু তোর এই অর্থ খরচের লাগাম টানা দরকার।

আতিকুল কোনো কথা না বলে নিজ রুমে চলে গেলো। একদিন বাজারে পাঁচ সাতজনের একটি দল আতিকুলকে ধরলো। সবাই এলাকার সন্তান, সন্তান মানে মস্তান। একজন বললো, মানুষকে টাকা দিয়ে সাহায্য করিস, এত টাকা কোথায় পাস?

আতিকুল বললো, আপনারা আমাকে এভাবে আটকালেন কেনো? আর এভাবে ব্যবহার করছেন কেনো? 

আরো একজন আরো রেগে বললো, গ্রামে কি করে বেড়াচ্ছিস সব রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে। তোর একাধিক নোংরামির খবরও আছে আমাদের কাছে। 

আতিকুল বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। মানুষের জন্য এত নিবেদিতপ্রাণ হয়ে আজ এই তার প্রতিদান! অন্য আর একজন সিগারেট টেনে নিয়ে বললো, দুশো চারশো একে ওকে দিয়ে প্রশংসা কুড়াতে চাস? মানুষকে সাহায্য করার জন্য কি সমাজপতি নেই? ভালো হয়ে যা, নতুবা পা ভেঙে হাতে তুলে দেবো।

নত মস্তিষ্কে আতিকুল বাড়ি চলে এলো। মানুষকে নিয়ে কিছু করায় ভাটা পড়লো। ও কখনো ভাবেনি এভবে অপদস্থ হবে, বাধাপ্রাপ্ত হবে। বাড়ি এসে স্থির থাকতে পারছে না সে। সমাজ নিয়ে বাঁচতে হলে সমাজের অন্যান্য মানুষও যা যা করছে তাই তাই করতে হবে। ব্যতিক্রম কিছু করতে গেলেই বিরুদ্ধ স্রোতের বাধায় পড়তে হবে। সবার আবদার মেনে নিয়ে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আতিকুল বিয়ে করলো। তার বৌ তাকে বলে, আমি তোমার সব কাহিনি জানি, এখন থেকে হিসাব করে চলতে হবে।

আতিকুল কথা বলে না, ভাবে, আগে কি আমি বেহিসাবি ছিলাম?

প্রতিবেশিনীরা কেউ কেউ এসে বলেন, এবার যদি আতিক ভালো হয়!

ঘাড় ঘুরিয়ে আতিকুল প্রতিবেশিনীকে দেখে ভাবে, আগে তবে খারাপ ছিলাম?

আর এক প্রতিবেশিনী বলেন, বৌ টা শক্ত আছে, এবার যদি আতিক পথে ফেরে!

যারা সমালোচনা করছে প্রত্যেককেই আতিকুলকে ভালো করে চেনে। কিছু বলে না, শুধু ভাবে, আমি কি তবে বিয়ের আগে বিপথে ছিলাম?

বেতনের টাকা আতিকুলের বৌ আগেই মুষ্টিবদ্ধ করে। আতিকুল বলে, আমি তোমাকে সহযোগী ভেবেছিলাম, আমাকে তুমি প্রতিপক্ষ করেছো।

আতিকুলের বৌ বলে, ছন্নছাড়া মানুষকে কিভাবে মানুষ করতে হয় আমার জানা।

একথা শুনে আতিকুল স্তম্ভিত হয়ে যায়। মূর্খের সাথে কথা না বাড়িয়ে ভাবে, এত কাজ করলাম, বিনিময়ে ছন্নছাড়া উপাধি পেলাম?

আতিকুল নামের আত্মোৎসর্গকৃত হৃদয়ের মরণ হলো। এখন সে প্রতি মাসে শাড়ি কেনে গরীব-দুঃখীদের জন্য না, বৌ এর জন্য। শীতেও শীতের পোশাক কেনে, কিন্তু তা বৌ, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, শ্যালকের জন্য। পড়াশোনার জন্য টাকা দেয়, কিন্তু দুস্থ শিশুদের জন্য নয়, শ্যালিকার জন্য। টাকা ঠিকই ধার দেয়, কিন্তু গরীবদের ভ্যান কেনার জন্য নয়, কুটুমের ব্যবসায়ের জন্য। তার বৌ হেসে বলে, বিয়ের আগে টাকা ছয় নয় না করলে জীবন আরো সুন্দর হতো। টাকায় টাকায় হয়। আগে উদার হস্তে টাকা নষ্ট করেছো আর শত্রুর সংখ্যা বাড়িয়েছো।

আতিকুল চুপ থাকে। কথা বলেই না। একটা প্রসারিত হৃদয় প্রসারিতই থাকলো, কিন্তু সেই প্রসারিত হৃদয় থেকে সমাজ আর আলোকিত হতে পারলো না।




No comments:

Post a Comment