Friday, July 15, 2022

গল্প || দেবযানী (পর্ব ১) || মলয় কোলে





দেবযানী   (পর্ব ১)

মলয় কোলে 

(১)
____কে! কে! কে ডাকছেন, কিছুটা ভয় ও অনিশ্চয়তা নিয়ে বলে উঠলো দেবযানী।
ক্লান্ত অথচ সাহসী একটা শব্দ ভেসে এলো ওপার থেকে, "আমি...আমি সমর, দেবযানী দরজা খোলো।"
"সমর, হঠাৎ তুমি এলে যে, এই এত রাতে একজন মহিলার ঘরে দরজায় কড়া নাড়তে তোমার বুক কাঁপলো না, আর কিভাবেই এলে তুমি;
বাবা-মা ঘুমিয়ে গেছে, অনেকক্ষণ আগেই;
____আর তোমার সুজনদা? 
___সুজনদা বাড়িতে নেই, আজ বিকেলের ট্রেনে জলপাইগুড়ি চলে গেছে,
____নবীনদা দেখতে পায়নি তুমি যে এত রাতে বাড়ির বাইরে বেড়িয়েছো!?
___অত প্রশ্ন করো না, কেও জানতে পারিনি; 

ঘরের ভিতরে ঢুকে সমর দরজাটা লক করে দিলো; ঘরটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বেশ লম্বাটে উত্তর দক্ষিণে একটু চ্যাপ্টা। ঘরময় দেওয়ালে নানান সব ছবি আঁকা আছে। কোনো জায়গায় দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণ ও রাধা একটা গাছের ডালে বসে একে ওপরের কাঁধে মাথা রেখে বাঁশি বাজাচ্ছে। আবার কোথাও বা একটা যুবতী নারী তার দুর্বা ঘাসের শেকড়ের মত কোমল কোমরে একটা কলসি ধারণ করে একটা তৃষ্ণার্থ বৃদ্ধকে জল বিতরণ করছে । সেই বৃদ্ধও তার দুই হাতের কব্জিতে তার ঠোঁট চুবিয়ে দিয়ে জল পান করছে। আরও সব কত ধরনের ছবি কোথাও বা নদীর ছবি কোথাও আবার বিভিন্ন ধরনের নকশা। তিনটি জানলা আছে ঘরটির মধ্যে, ঘরের এককোনে বিছানা পাতা আছে, খাটটিও বেশ পুরনো গোছের, দেখে মনে হবে কোনো রাজ রাজাদের খাট যা সব ডিজাইন আছে তাতে, বেশ পরিপাটি ঘরটা যেখানে যেটা থাকার দরকার সেখানে সেটা রাখে আছে , দক্ষিণ দিকের জানলাটা বাকি দুটো জানলার থেকে অনেক টাই বড়ো। এই জানলার  কারুকার্য দেখেলেই মনে হবে বাড়ীর মালিকের শিল্পের দিকে ভালই ঝোঁক আছে। পূর্ণিমার রাতে চাঁদ যেন এই জানালা দিয়েই ঘরের ঢোকার তাল করে, জানলার পাশেই একটা টেবিল ও চেয়ার, টেবিলেই উপর কিছু বই তাক করে রাখা আছে ও একটা স্ট্যান্ড লাইট আছে। দেবযানী বই পড়তে খুব ভালোবাসে সে এখানে বসে রাতের পর রাত দিনের পর দিন বই পড়ে। 
 সমর ভিতরে ঢুকতেই দেবযানী জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সমরের দিকে মুখ করে। সমর আসতেই দেবযানী ঘরে আবার নতুন করে আলো জ্বেলেছে তাই চাঁদের আলো ঘরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না, টেবিলের আলোটা মাথা ঝুঁকে একটা বন্ধ করা বইয়ের উপর পড়ছে। দেবযানী বই পড়ছিল এতক্ষন। সমর কিছু বলবে বলে দেবযানী মুখের দিকে তাকাতেই চুপ করে গ্যালো। দেবযানীর এই মুখ আগে দেখেনি সে, তার মুখে লজ্জা নেই কোনো রাগ বা ভয়ও নেই, দেখে মনে হলো খুব কাতর। মুখময় একটা মায়া যেন ধীরে ধীরে তার সতেজ-শান্ত মুখটাকে আক্রান্ত করছে। যদি কোনো প্রাচীন ইতিহাসের কোনো বীর রাজার রাজ্যের একটি সাহসী নারীর দলের একটি কন্যা কে হঠাৎ করে বর্তমানের ভীরু ও সংকোচের সমাজে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, সে যতই সাহসী হোক না কেনো তার যেমন সবটা অবাক লাগবে আর সব কিছু বুঝতে তার মুখে যে শিশুসুলভ একটা রেখার আবির্ভাব ঘটবে, ঠিক তেমন লাগছিল দেবযানির মুখটা। একটা নিস্তব্ধতা এতক্ষন ঘরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল, সেটাকে ভেঙেই দেবযানী বলে উঠলো 
_____কেনো এসেছ এত রাতে ? তুমি জানো না যে আমি একজন...
দেবযানীর কথা থামিয়ে সমর বললো
_____ হ্যাঁ আমি জানি। আমার ঘুম আসছিলো না, সন্ধ্যে থেকে শুধু তোমার কথা মনে হচ্ছে। 
শুধু ভাবছি তোমার কথা, এই কয়েক মাসে তোমার প্রতি আমার যে একটা টান তৈরি হয়েছে সেটা আমায় কিছুতেই তোমার ছাড়া থাকতে দিচ্ছে না।
____ কি করবে বলো, সব চাওয়া কি পাওয়ায় পরিণত হয়! 
একটু থেমে সে আবার বললো, আর এমন কিছু কেনো চাইছো যেটা পূরণ করা যাবে না। আজ তোমার টান আছে কাল যদি না থাকে তখন আমি কোথায় আমার শরীরকে লোকাবো বলো! 
 এটা বলেই দেবযানী নিজে থেকেই চুপ হয়ে গ্যালো। সমর দেখলো তার চোখে জল এসেছে, সেটা অবশ্য এখনও বাঁধ ভাঙেনি। সমর ও দেবযানীর মধ্যে এতক্ষন দুরত্ব ছিলো অনেকখানি, সেটা ভেঙেই সমর দেবযানীর একদম কাছে চলে এলো। দেবযানীর দুটি হাত জোড় করে চেপে ধরে রাখলো এমন একটা রক্ত - মাংসের যন্ত্রের উপর, যাকে সবাই হৃদয় বলে। 
'তুমি কেনো বোঝো না এই প্রেম, এই টান মিথ্যে নয় দেবযানী, মিথ্যে নয়; আমার ভালোবাসায় যে গভীরতা আছে যে প্রগাঢ় একটা নেশা আছে সেটা শুধু তোমার জন্যই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তুমি একে মরে যেতে দিও না দেবযানী! দিও না! এইবলে সমর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতক্ষণে দেবযানীর দুটো চোখের জল তার চোখের বাঁধ ভেঙে গালে গড়িয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে একটা বিকট নীরবতার জন্ম হয়েছে, সেটা খুব চেষ্টা করছে চিৎকার করার, কিন্তু কেউ যেন তার গলা টিপে ধরে আছে, তাকে নিস্তার দিচ্ছে না। 
(ক্রমশ)



No comments:

Post a Comment