Friday, July 15, 2022

প্রবন্ধ || বটু কৃষ্ণ হালদার



বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব সৌরভ গাঙ্গুলীর ক্রিকেট প্রতিভাকে নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল

বটু কৃষ্ণ হালদার

সমগ্র বিশ্বের দরবারে বাঙ্গালী জাতি হল আবেগ ও বিস্ময়কর নাম। যার কারণে শুধুমাত্র বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির টানে বহু পর্যটক এই বাংলায় আসেন প্রতিবছর।তাদের কাছে বাংলা হল শান্তিনিকেতন,সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার,গড়ের মাঠ,কু_ঝিক ঝিক ট্রাম,কলকাতার রসগোল্লা,দক্ষিণেশ্বর,বেলুড় মঠ,ইমাম বাড়া, স্বামী বিবেকানন্দ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবি ঠাকুর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস,আরো কত কিছু।তার সঙ্গে অবশ্যই বাংলা মায়ের দামাল ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলী। ফুটবল খেলা প্রিয় বেহালার ছেলেটির ক্রিকেট জীবনের শুরুটা মোটেই সহজ সরল ছিল না। কারণ তিনি যে বাঙালি। আর বাঙালি মানে ভারতবর্ষের কাছে অবহেলিত অবাঞ্চিত একটা জাতি।কারণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্ত ছিল এই পশ্চিম বাংলা।আর বাঙালিরা স্বাধীনতার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে উঠেছিল, তাদের সাথে সাথেই সমগ্র ভারত বাসি একই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। বাঙালির হাত ধরে অস্কার,নোবেল সহ বহু পুরস্কার এসেছে। তাই একসময় বলা হতো বাঙালি আগে ভাবতে শুরু করে,আর দেশ তার পিছু পিছু। অথচ স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে,আর দেশ এগিয়ে গেলেও বাঙালি অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে।বাঙালি আজ ভিক্ষা করা জাতিতে পরিণত হয়েছে।দোষ শুধু অন্যকে দেওয়া যায় না।বাঙালি কাঁকড়া যাতে পরিণত হয়েছে। বাঙালি শুধু নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। জাতে জাতে মিল নেই।কেউ এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে পিছন থেকে টেনে পিছনের সারিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় মশগুল হয়ে পড়ে। তবুও সবকিছু বাধা-বিপত্তি কাটিয়েরবি শাস্ত্রীয় বচনে "কোটার মাল" থেকে ভারত অধিনায়ক হয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে উত্তরণের পথ টা লড়াকু মানসিকতাদের কাছে বাঁচার প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।তবে সব বাঙালি যে বাঙালি বিদ্বেষী নয় তার অন্যতম প্রমাণ হলো সংবরণ ব্যানার্জি। সৌরভ ক্রিকেট জীবনে উদয় হওয়ার পিছনেও
তার অবদান একেবারে ভুলে যাওয়ার নয়।
গত দুই বছরে সৌরভ গাঙ্গুলীর ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আর সম্বরণ ব্যানার্জির উপস্থিত বুদ্ধি,গলার জোর,মেরুদন্ড শক্ত করে থাকা সব মিলিয়ে মিশিয়ে সৌরভ ভারতীয় দলে ঢুকে পড়েন। তবে নির্বাচক কমিটিতে সেবারে বাঙালিবিদ্বেষ চরমভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল।নির্বাচন কমিটির বৈঠকের পরে প্রবল বাঙ্গালী বিদ্বেষী মুখ্য নির্বাচক সন্দীপ পাতিল ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন_” আজ সম্বরণ আমাদের খাওয়াবে।সৌরভকে শেষ পর্যন্ত ও দলে ঢুকিয়েই ছাড়ল।”ব্যাপারটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে মধ্যাঞ্চলের নির্বাচক গোপাল শর্মা চিৎকার করে বলতে বাধ্য হন – ” শাট আপ স্যান্ডি ।সমস্ত কিছুর একটা সীমা আছে ।”উত্তরে মৃদু হেসে সম্বরণ ব্যানার্জি বলেছিলেন – ” তোমাদের তুলনায় এই বাঙ্গালী একটু গরীব,কিন্তু নিশ্চই খাওয়াবো। তবে সৌরভকে দলে ঢোকাতে পারলাম বলে নয় , ভারতীয় দলকে সৌরভের মতো একটা ক্রিকেটার দিতে পারলাম বলে।
১৯৯৬ সালে সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির পর মুম্বাই এবং দক্ষিণী লবির সাংবাদিকরা গেল গেল রব তুলেছিল যে কেন ভি ভি এস লক্ষণ এর মতো প্রতিভাবান প্লেয়ার থাকতে একে দলে ঢোকানো হল ?বাঁ হাতিই যদি নিতে হয় তাহলে অভিজ্ঞ ডব্লিউ ভি রমনকেই আবার ডাকা যেত।তখন ভারতীয় বোর্ডের কিছু বাঘা কর্মকর্তা তাদের আশ্বস্ত করে দিয়ে বলেছিলেন,আরে বহুদিন ধরে বেঙ্গল থেকে কোন প্লেয়ার নেওয়া হয় না,বোর্ড নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে কোটা হিসাবে একজনকে নেওয়া হয়েছে আর নিলেই কি খেলাতে হবে নাকি ? স্বয়ং আজাহার নির্বাচনী সভায় সৌরভের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে তুলকালাম করেছিলেন ।
ইংল্যাণ্ডের দল ঘোষণা হওয়ার পরে সৌরভকে নিয়ে প্রথম বিদ্রুপটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন গাভাস্কার – ” ও তো কলকাত্তা কা রসগুল্লা হ্যায় ! ”
রবি শাস্ত্রী সরাসরিই বলেছিলেন –কোটার মাল।
আসলে এরা সবচেয়ে ভাল ওয়াকিবহাল ছিলেন সৌরভের ক্ষমতা সম্পর্কে । তাই সৌরভ গাঙ্গুলীর ভবিষ্যৎ মহীরুহ হওয়ার সম্ভাবনাকে অচিরেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন ।১৯৯৬ এর ইংল্যান্ড সফরে সৌরভের ক্যারিয়ার চিরকালের মতো শেষ করে দেওয়ার ব্লু প্রিন্ট ফ্লাইটে বসেই বানিয়ে ফেলেছিলেন আজাহার আর পাতিল ।হোটেলে চেক ইন করার পরে আজাহার সৌরভকে বলেছিলেন – ” ভালো করে ইংল্যান্ড ঘোর,বাজার কর,আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করো,মানে ভুলেও ক্রিকেট খেলার বা দলে জায়গা পাওয়ার কথা মনে স্থান দিও না।প্লেয়ারদের ফিডব্যাক রিপোর্টে সৌরভ সম্পর্কে ভয়ংকর সব অভিযোগ করেছিলেন পাতিল ।পাতিল জানতেন ১৯৯৬ সালে সৌরভ যখন ভারতীয় দলে প্রথম নির্বাচিত হন তখন তার নাম শ্রীকান্ত,শাস্ত্রী সহ বেশ কিছু প্লেয়ার অভিযোগ করেছিলেন সৌরভ নাকি উদ্ধত এবং তাদেরকে সিনিয়র ক্রিকেটার হিসাবে সম্মান করেন না । যেটা সৌরভ পরে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ বলেছিলেন । সেটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন পাতিল ।রিপোর্টে লিখলেন ” সৌরভ টিমম্যান নন , ম্যাচের আগে কারোর সাথে কথা বলেননা , একাএকা ঘুরঘুর করেন । ” এখানে আমরা নিজেরা যারা খেলাধুলা অল্পবিস্তর করি তারা একটা কথা বলতে চাই যে, খেলাধুলায় চূড়ান্ত ক্ষেত্রে নামার আগে মনোসংযোগ বলে একটা কথা আছে । ইচ্ছাকৃতভাবে বিনোদ কাম্বলীর রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্যে পাতিলরা ওই কাজ করেছিলেন।
আজহারের সাথে সিধুর ইগোর লড়াই চরমে পৌঁছে সিধু মাঝপথে সফর ছেড়ে চলে এলেও সৌরভের নাম ভাবা হয়নি । রাহুল দ্রাবিড় আর বিক্রম রাঠোরের নাম ভাবা হয়েছিল।কিন্তু এরপরে প্র্যাকটিসে সুনীল জোশির আঙ্গুল ভাঙ্গায় কোনভাবেই উপায় না দেখে সৌরভকে খেলাতে বাধ্য হয় ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট।লর্ডসের স্যাঁতস্যাঁতে পিচে সৌরভকে ওয়ান ডাউনে ঠেলে দেন পাতিল আজাহার জুটি।উদ্দেশ্য পরিষ্কার সৌরভ ডমিনিক,কর্ক আর এলান মুলালির বিষাক্ত সুইং এর সামনে খাবি খেয়ে অল্প রানে আউট হবেন আর তারপরেই ওৎ পেতে থাকা মুম্বাই আর দক্ষিণী মিডিয়ার সাহায্যে শেয়ালের চিৎকার করে সৌরভ অযোগ্য এই বলে সৌরভের ক্যারিয়ার জন্মের মতো শেষ করে দেওয়া হবে । সঙ্গ দেওয়ার জন্যে মাত্রাতিরিক্ত উদার , খাঁটি ভারতীয় বাঙালী কাঁকড়ারা তো আছেই ।তারপর এলো চ্যাপেলওয়ে। বিদেশে সিরিজ জিতেও গেল অধিনায়কত্ব। আবার লোকটা বাদ। আবার চ্যালেঞ্জ। রঞ্জি খেলে ফিরে আয়। দেখি কত বড়ো মাচো তুই।চ্যাপেল কান্ডে সারা ভারতের ক্রিকেটপ্রেমী সৌরভ এর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল আর ভারতীয় বোর্ড ছিল সৌরভের বিপক্ষে ।সারা জীবনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে বেঙ্গল টাইগারকে।প্রথমে বলা হোত ক্রিকেটই খেলতে পারেন না , লর্ডসের পরে নতুন গান শুরু হল টেস্টে মোটামুটি চললেও ওয়ানডে এর দ্বারা হবে না । টরন্টোতে একটা ম্যাচে কুম্বলেরও পরে আট নম্বরে সৌরভকে ব্যাট করতে পাঠিয়েছিলেন পাতিল । খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন সাকুল্যে আটটা বল । ১২ রানে নট আউট ছিলেন । তারমধ্যেই ওয়াসিম আকরামের একটা ব্যানানা ইনসুইঙ্গারকে স্ট্রেট ড্রাইভে বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছিলেন , শটটা আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ।পরের ম্যাচেই বাদ পড়েছিলেন । সেইজন্য নিজের দশহাজার ওয়ানডে রান পূর্ন করার পরে একটা দুর্দান্ত স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন , তখন চ্যাপেল, মোড়ে দুই জোড়া ফলা দিয়ে সৌরভকে ছিন্নভিন্ন করছেন শরদ পাওয়ার । খুব ভালো সিংগেলস জাজ করতে পারতেন , সেইজন্যে অতিরিক্ত বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে নির্বোধের মতো রান আউট হতেন না এটাকে একশ্রেণীর মিডিয়া প্রচার করতো সৌরভ রান নিতে পারেন না । ঘোড়াতেও হাসবে শুনলে । শচীন, দ্রাবিড় ক্যাচ ফেললে ওটা ক্রিকেটেরই অঙ্গ কিন্তু সৌরভের একটা মিসফিল্ড হলেই খাঁটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ক্রিকেটপ্রেমী বাংগালী কাঁকড়াগুলো গেল গেল রব তুলেছে । অথচ সৌরভের মতো উচুঁ ক্যাচ ধরার দক্ষতা অতীত বর্তমান মিলিয়েও কোন ভারতীয় ক্রিকেটারের নেই । ফ্লাড লাইটের ওপরে চলে যাওয়া ক্যাচগুলো কি অসাধারন দক্ষতায় তালুবন্দী করতেন । ক্লোজ ইন ফিল্ডার হিসাবেও দুর্দান্ত ছিলেন ।
২০০৬ এর শেষদিকে সৌরভের কামব্যাক যখন নিশ্চিত । তখন কাছের লোকেরা বলেছিল – ” এত তাড়াহুড়োর দরকার কি , এই সিরিজটার ওপরে সারা জীবনের ক্রিকেট ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে আছে । তোমাকে আতস কাচের নিচে ফেলে দেখছে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব , কি দরকার দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রিনটপে গিয়ে স্টেইন , মরকেল, এনতিনিদের মুখোমুখি হওয়ার ? এরচেয়ে অনেক দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতে আসছে এরপরেই ওদের বিরুদ্ধে সহজ সিরিজে কামব্যাক করো । ”
উত্তরে দেওয়ালের কোনা থেকে ব্যাট তুলে উত্তেজিত ভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সৌরভ ।জবাব দিয়েছিলেন – ” এইভাবে কাপুরুষের মতো ক্রিকেট কেন কোন খেলাই হয় না , এইভাবে বাচঁতে শিখিনি , যার সত্যিকারের ক্ষমতা আছে সে স্থান আর প্রতিপক্ষ বিচার করে না । যদি ক্ষমতা থাকে তো ওখানেই কিছু করে দেখাবো । ” কি করেছিলেন ইতিহাসে লেখা আছে ।
পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতার নিজের আত্মজীবনীতে সৌরভ সমন্ধে লিখেছেন – ” শরীরটা মানুষের কিন্তু ভেতরের খাঁচাটা দৈত্যের ।
কি আশ্চর্য্য কথা , একজন ক্রিকেটার যে সারা জীবন শান্তিতে ক্রিকেটটাই খেলতে পারেননি ।
সত্যিই তিনি এইরকম সংগ্রামে সবসময় বুক চিতিয়ে চোখে চোখ রেখে সিংহের গুহা থেকে খাবার ছিনিয়ে এনেছে, প্রকৃতঅর্থে তিনি একজন সংগ্রামী।তাইতো তিনি সবার প্রিয় দাদা। তাইতো তিনি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। শুধু ভারত নয় সমগ্র বিশ্বে তার ক্ষমতা জাহির করেছে। বিশ্ব ক্রিকেট যখন কালো বাজারের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়েছে,তিনি সেখানে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় দল অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন।বহু প্রতিভাবান নবাগত ক্রিকেটাররা তার হাত ধরেই উঠে আসেন। অবসর পরবর্তীতে বাংলার মহারাজ বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। সেখানেও তিনি দুর্দান্ত ভাবে সফল। দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে বর্তমানে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। আমরা জানি সেখানেও তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দুর্নীতিকে দূরে হটিয়ে ক্রিকেট বোর্ডকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন।




কবর ডাঙ্গা,কল_১০৪


No comments:

Post a Comment