Friday, July 15, 2022

মুক্তগদ্য || শৈশবের অপাঠ্য পুস্তক || বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী




শৈশবের অপাঠ্য পুস্তক

বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী

বাংলা বইয়ের প্রতি স্পর্শকাতরতা শুরুর দিনগুলো বিদ্যালয় গমনাগমনের মাধ্যমে । মূলতঃ পাঠ্য পুস্তকের টালের দিকে তাকালে বাংলা পাঠ্য বইয়ের সুললিত পদ্য , গল্প ইত্যাদির প্রবল আকর্ষণ অনুভব করাই দস্তুর । আর দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা পাঠ্য বইয়ে গল্প ও কবিতা ছাড়া আর কিছু তো থাকত না । বাংলা সাহিত্যের রথী মহারথীদের সঙ্গে পরিচয় এভাবেই । ক্রমশঃ বিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর প্রতি নজর শুরু । পাঠ্য পুস্তকের মধ্যে লেখক সাহিত্যিকদের নাম এবং ভাল লাগা মন্দ লাগা নিহিত থাকত । সুতরাং তার ভিত্তিতে লাইব্রেরী থেকে স্কুল ছুটি হলে গল্পের বই নিতাম । টিফিন পিরিয়ডে গল্পের বইয়ের নাম এবং লেখকের নাম লিখে একটা রেজিস্টারে নিজের নাম সই করে রাখতাম । দপ্তরী মশাই বই আলমারী থেকে মিলিয়ে বের করে রাখতেন । তারপর স্কুল শেষে অফিসে গিয়ে বই তুলতাম । রেগুলার বই পড়ে জমা দিয়ে আবার বই নেওয়ার আবদার ধরলে দপ্তরী মশাই কি যে রেগে যেতেন , বলতেন , তোরা হইছিস ছিনে জোঁক । রোজ রোজ বই নিতে হবে ? 
এভাবে কিন্তু শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রতি টান । লেখক তালিকায় যেমন বাংলার লেখকরা থাকতেন , তেমনি বিশ্ব সাহিত্যের লেখকরাও থাকতেন । আর্নেস্ট হেমিংওয়ে , চার্লস ডিকেন্স , আলেকজান্ডার দ্যুমা , ড্যানিয়েল ডি ফোঁ , রবার্ট লুই স্টিভেনসন , শেক্সপিয়ার , হ্যারিয়েট বিচার স্টো , জুলে ভার্ন নামের তালিকা দীর্ঘ করলাম না । আর বাংলা সাহিত্যের রথী মহারথীদের নাম করতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , নীহাররঞ্জন গুপ্ত , নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় , অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর , সৈয়দ মুজতবা আলী , সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ , ধীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী , শিবরাম চক্রবর্তী , স্বপনকুমার , মোশারফ হোসেন , নারাযণ গঙ্গোপাধ্যায় সে এক এলাহি তালিকা । 
এই লেখকদের রচনার পরিচয় অনেকাংশে পাঠ্য পুস্তকের হাত ধরে । তারপর তো লাইব্রেরীর ক্যাটালগ থেকে । সুতরাং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক তো অপাঠ্য পুস্তকই চিনিয়ে দিয়েছিল । বিশ্ব সাহিত্যের লেখকরাও বাংলা অনুবাদের সূত্রে ধরা দিয়েছেন আমার কাছে । 
এরপর চেনা হতে লাগল ম্যাগাজিন গুলোর সঙ্গে । বাংলা সাহিত্যের সাময়িক পত্র পত্রিকার অভাব নেই । ভালো খারাপ দুই ই গোগ্রাসে গিলতে বাধ্য করত যত রাজ্যের অপাঠ্য পুস্তক । একটা কথা এই সময়ে বুঝেছি বই ভালো মন্দ সব রকমের আছে । নিয়ে পড়লে ক্ষতি হয় না । বই কখনো খারাপ করে না । খারাপ করে নিজের মনের অবস্থা মাফিক বই নির্বাচন । যৌন পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে কত পড়েছি । বয়েস অনুযায়ী ভালই লেগেছে । বই আনন্দ দেয় । সব সময় ভালো বইয়ের তালিকায় অযৌন পত্র পত্রিকা থাকতে হবে এমন কথা বিশ্বাস করি না । যৌন সাহিত্যও সাহিত্য সৃষ্টির দাবি রাখে বৈকি । ভালো খারাপ বই নিজে বলে দেয় না , বলে নিজের অনুভূতি । আবার অবাস্তব বিষয়ের বই রস সৃষ্টির ভান্ডার সমৃদ্ধ করে । উদ্ভট বা ননসেন্স সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট পারদর্শিতা লাগে । 
তা জীবনে শৈশব কাল হল এমন একটা সময় যখন মনে কোন সাংসারিক চিন্তা থাকে না । গুরুভার কোন দায়িত্ব থাকে না । ভালো মন্দ ভবিষ্যতের সব দায়িত্বই তো থাকে বাবা মায়ের হাতে । আমাদের শৈশব আমরা তাঁদের ওপর ন্যাস্ত করেই ক্ষান্ত । 
আর অন্য আনন্দ তো টেকনিক্যাল কোন মাধ্যম নির্ভর হয় নি । টেকনোলজির বালাই ছিল না । হয়ত এই কারনেই বাংলা সাহিত্যের আকর্ষণ তীব্র ছিল । এখন আবার অতিমারী / মহামারী আমাদের গৃহবন্দী করার ফলে সাহিত্যে মনোনিবেশ করাও বেড়েছে । আর ঘরে বসে নতুন নতুন বইয়ের খবর জানা এবং যে কোন 
বই ফেসবুক দেখে অর্ডার করলেই তা চলে আসছে । ইন্টারনেটের দৌলতে বিশ্বসাহিত্য বাংলা ভাষায় পাওয়া দুর্লভ নয় । মোদ্দা কথাটা
হল শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলো দিয়ে সাহিত্যের যে জয়যাত্রার শুরু , বিশেষতঃ আমাদের আটপৌরে লাইফস্টাইলে তা সাহিত্যের মনোগ্রাহীতা আজ অবধি বজায় রেখেছে অপাঠ্য পুস্তকের কল্যানে । তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে নানা আখ্যান , নানা ভাষার রচনা পড়া কোন অপাঠ্য পুস্তক পড়ার নামান্তর নয় । বরং সাহিত্যের সমাদর লাভে সক্ষম । 

পাঠকদের মনে রাখতে হবে যে আমি শৈশবের অপাঠ্য পুস্তক নামকরণ করে যে রচনাটি লিখতে চেয়েছি তা হলো , বিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত যে পাঠ্যসূচী সেখান থেকে শুরু করে সাহিত্যের সুবিশাল ভান্ডারে প্রবেশ তা পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত নয় । অর্থাৎ বিদ্যালয়ে প্রবেশ সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে আবশ্যক হওয়ার পর সাহিত্যের সঙ্গে সম্যক পরিচয় । প্রথমে পড়তে জানা , তারপর ভাষার প্রতি আগ্রহ , তারপর বক্তব্য বিষয়ে আসক্তি , এগুলো পরপর আসছে বটে , তবে অপাঠ্য পুস্তক যাতে নম্বর মেলে না তাই দিয়ে সাহিত্যকে চেনা জানা । 



ঠিকানা : 
গ্রাম : বিশ্বনাথপুর
পোস্ট : রামনাথপুর
জেলা : উত্তর২৪পরগনা
পিন : ৭৪৩৪২৩



No comments:

Post a Comment