বোবা টানেল
সৌরীণ মুখার্জী
জোয়ার শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। আমাদের যাবতীয় কোলাহল মুছে গিয়ে ঢেউয়ের আওয়াজটা ভীষণ প্রকট হয়ে উঠছিল। পর্যটন বাণিজ্যর মেকি ব্যানারে এই জায়গাটা এখনও চাপা পড়েনি। এখানে রাত হলেই বড় বড় হ্যাজাক জ্বলে না, মশালের মত কয়েকটা আলো ইতিউতি ছড়িয়ে। তবে তা-ও নেহাতই প্রয়োজনে।
তাঁবুর বাইরের কাপড়টা হাওয়ায় কাঁপছিল, সমুদ্রের নোনা হাওয়া- একটা অন্যরকম গন্ধ মিশে থাকে তাতে। দূরে কোথাও গিটার বাজছিলো, ভাঙা ভাঙা গলার স্বর আর সুর এসে পৌঁছেছিলো আমাদের তাঁবুর ভেতর। আমাদের অহেতুক কথাগুলো তখন একদম মানাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো ওই মুহূর্তে সব অপ্রয়োজনীয় শব্দগুলো বোবা হয়ে যাক-অফিসের কাজ, প্রমোশনের পলিটিক্স, ফ্ল্যাটের ইএমআই, রাজনীতির দলবদল... সবটা।
ধীরে ধীরে রাতের বয়স বাড়লে মাঘী পূর্ণিমার মস্ত চাঁদটা সাগরের ঠিক মাঝখানে এসে থামবে। ওই স্নিগ্ধ আলোটুকুর যে তখন বড় প্রয়োজন। চারিদিকের প্রশান্তিতে ঢেউয়ের একঘেয়ে শব্দটা আর ওই গিটার ভীষণ মানিয়ে উঠেছে তখন। আমি তখন তাঁবুর দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি, সিঁড়ি গুলো পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি সমুদ্রের দিকে...
তুমি বলেছিলে এক দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে আর তারপর প্রথম যে জিনিসটা মাথায় আসবে তার কথা বলতে হবে। আমি বেকুবের মত খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে উত্তর দিয়েছিলাম - ব্যাপ্তি। আমার উত্তরে অবাক হয়েছিলে তুমি, নাকি আমার ভাবনার পরিধি তোমার ভাবনাকে ছুঁতে পেরেছিলো বলে? সেটা অবশ্য জানি না। তবে আমার সেই একই প্রশ্নে তুমি বলেছিলে - শ্রী চৈতন্য। আমিও অবাক হয়েছিলাম, তোমার ভাবনাদের ছুঁতে না পারার কারণেই । তুমি বলেছিলে - কথিত আছে এরকমই কোনো দিনে শ্রী চৈতন্য শ্রী কৃষ্ণের নাম জপ করতে করতেই সমুদ্রের মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন, ঢেউ এসে মুছে গিয়েছিলো তাঁর পায়ের ছাপ। আমি আবার সেই বেকুবের মত একবার তোমার দিকে তাকালাম আর একবার সমুদ্রের দিকে। আমিও বোধহয় এবার তোমার ভাবনার নাগাল পেলাম। এর মধ্যে খেয়ালই করিনি ঢেউ এসে কখন যেন মুছে দিয়ে গেছে বালির ওপর আমাদের নামগুলো। ও-ও কি কিছু ঠাহর করেছিল?
আমাদের সম্পর্কের ব্যাপ্তি কতখানি ছিল আজ আর তা ভাবি না, সমুদ্র দেখলেও আর 'ব্যাপ্তি'র ভাবনা চাগাড় দেয় না। তবে আজ এতদিন পরেও একা একা যখন সমুদ্রের খুব কাছাকাছি আসি, মনে হয় কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে ঢেউয়ের অভিমুখে। ঢেউ এসে ভাঙছে পায়ে, গায়ে - তবুও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিছু বলছে কিনা সে আমি বুঝতে পারি না। আমার কান জুড়ে তখনও ঢেউ আর গিটার । মানুষটা এগিয়ে চলেছে আরও দূরে, আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে পায়ের ছাপ। আমি চোখ সরিয়ে নিই, আমার সাহসে কুলোয় না। ভয় হয়, যদি পিছু ফিরে দেখে আমি বোধহয় তাকাতে পারবো না, মানুষটা যদি খুব চেনা কেউ হয় কিম্বা যদি তুমি....
সমুদ্রের কাছে গেলে ঘুমটা বড্ড অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় আজকাল। রাতভর তাই ঢেউ দেখি, গান গাই, কথাদের থেকে দূরে দূরে থাকি। আর ইচ্ছে হলেই বালির গায়ে নাম লিখি - মুছে যাবে জেনেও।
Flat 1A, Aahan Apartment
183/A, Pulin Avenue, Malancha
KOLKATA, WEST BENGAL 700081
No comments:
Post a Comment