Friday, April 15, 2022

গল্প || অনন্ত মায়া || অভীক সাধু



ছোটবেলাতেই বাবাকে হারানোয় পলাশকে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে | মামাবাড়িতে আশ্রিত পলাশকে স্কুলের বাইরে প্রাইভেটে পড়ানোর সামর্থ্য ওর মার ছিল না | তাই পলাশের রেজাল্ট খুব একটা আহামরি কিছু হয়নি |
 বিভিন্ন কাজের জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়ে চেষ্টা করতে করতে কতকটা ভাগ্যক্রমেই পুলিশের চাকরিটা সে পেয়ে যায় | পলাশের পোস্টিং হলো একেবারে বাংলাদেশ ভারত বর্ডারের কাছের জনপদ কৃষ্ণগঞ্জে ! যদিও তার মায়ের ইচ্ছে ছিলোনা যে ছেলে এতদূরে চলে যায় , কিন্তু অভাবের ঘরের ছেলেমেয়েদের ইচ্ছেমতো চাকরি বেছে নেবার বিলাসিতা চলেনা | বড়মামা রেলে কাজ করার সময় একবার গেদেতে পোস্টেড ছিলেন | তিনি পলাশকে বললেন " দেখো যে সব জায়গা বর্ডারের কাছে, সে জায়গাগুলো কিন্তু চোরাচালানকারীদের স্বর্গরাজ্য ! আমি কুড়ি বছর আগে ছোটোখাটো স্মাগলিং থেকে মেয়ে পাচার সবই দেখেছি | বর্তমান সময়ে ওখানে যে কি কি হয় , তা বোধহয় স্বয়ং ভগবানও জানেন না !"
পলাশের মা বলেন -"কিআর করি বলো দাদা ? হাজার হোক সরকারি চাকরি | "
বড়মামা তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন - " না রে ,আমি কি আর চাকরি না নিতে বলেছি ? রেল আর পুলিশের কাজের পার্থক্য আছে | ছোট জায়গাতে পুলিশই সরকার |"
পলাশ মুখ টিপে হাসে | সে মনে মনে ভাবে -" হ্যাঁ , বেশি বললে পাছে আমি চাকরিতে যদি যোগ না দেই | তাহলে তো আবার তোমাদের ঘাড়ে বসেই আরো কতদিন অন্নধ্বংস করবো , তার তো কোনো ঠিক ঠিকানা নেই ! চাকরির আজকাল যা বাজার | তার থেকে এই ভালো |"
 কৃষ্ণগঞ্জ থানাতে বড়বাবুকে রিপোর্ট করার পর উনি পলাশকে কাজ বুঝিয়ে দেন | বলেন -" দেখো পলাশ, আমাদের থানাতে রাত্রে কড়া নজর রাখতে হয় | প্রশাসনের উপরমহলের তাই নির্দেশ | তাই আমাদের সবাইকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাতে পেট্রোলিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে হয় | নেক্সট উইকে তোমার রাত্রে পেট্রলিং পড়বে | " উনি আরো বলেন,"এখানে একটা মাত্র জিপ -কিন্তু সেটাও বিকল | কবে সরানো হবে তা জানি না | তুমি আর আরেকজন কনস্টেবল বাইকে করেই টহল দেবে | পলাশ একটু দমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে -"এখানকার ক্রাইম রেট কি খুব বেশি ?" বড়বাবু কাষ্ঠহেসে অভয় দেন , বলেন -" ঘাবড়াচ্ছো কেন ?" পলাশ যা বোঝার বুঝে নেয় | যাহোক পলাশের জায়গাটাকে ভালোই লাগে | বড়বাবু সুরেশ রাশভারী হলেও হেল্পফুল | প্রায় বছরখানেক পলাশের থাকা হয়ে গেলো কৃষ্ণগঞ্জে | এর মধ্যে ছুটকোছাটকা অপরাধ ছাড়া বড় কোনো ক্রাইম থানাতে রিপোর্ট হয় নি | অথবা, পলাশ ভাবে : যা ঘটে তার নেপথ্য ব্যক্তিরা হয়তো গভীর জলের মাছ , সেসব খবর হয়তো থানা পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না ! একদিন পলাশের সাথে রবিনের রাত্রে পেট্রোলিংয়ের দায়িত্ব পড়ে | কিন্তু সন্ধ্যে থেকেই রবিনের পেটের গোলমাল | পলাশ ওকে বলে -"তুই আজ রেস্ট নে - আমি একা সামলে নেবো !"

 মেন রোডে বাইক নিয়ে এগিয়ে চলে পলাশ | হটাৎ দেখে একজন কালোমতো লম্বা লোক তাকে হাত তুলে থামতে ইশারা করছে | সে বাইক থামিয়ে বলে "কি ব্যাপার ?" লোকটি গম্ভীর গলায় বলে "তিনজন লোক একটা চাষীর মেয়েকে পাম্পঘরে তুলে নিয়ে গেছে | চলুন !" পলাশ বলে -"কিন্তু আপনি জানলেন কি করে ?" লোকটি বলে -"নষ্ট করার মতো সময় এখন নেই |" লোকটির গলা যেন আদেশের মতো শোনায় | পলাশ লোকটির নির্দেশমতো পথে বাইক চালিয়ে পাম্পঘরে পৌঁছায় | তাকে দেখে একজন বলে ওঠে " আপনি ভেগে পড়ুন নইলে .." গলার স্বরে সে চিনতে পারে যে লোকটা বাবিন -এলাকার ত্রাস | পলাশ রিভালবার তুলতেই অন্ধকার থেকে একটা ছুরি কে যেন ছুঁড়ে মারে - একটুর জন্য তা লক্ষভ্রষ্ট হয় | এই গোলমালে মেয়েটি পালায় | বাবিন চেঁচিয়ে ওঠে -"ধর শালীকে !" পলাশকে ধাক্কা দিয়ে তিনজন মেয়েটার পশ্চাদ্ধাবন করে ! পলাশ শানের উপর পড়ে যায় | সে দেখে মেয়েটা কিছু দূরের একটা কুঁড়েঘরে ঢুকে গেলো | পলাশের কিরকম যেন লাগে | যখন বাইক চালিয়ে এলো , এলের পাশের এই আধভাঙা ঘরটা এখানে ছিল কি? ওরা তিনজন ঘরটাতে ঢুকে গেলে | পলাশ ওদের জান্তব উল্লাস শুনতে শুনতে উঠে দাঁড়ায় | পলাশ দেখে ওই কালোমতো লোকটা ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে | পলাশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরটার কাছে গিয়ে দরজা খুলতে গেলে লোকটা বাধা দেয় ! পলাশ অবাক হয়ে বলে "কি করছো ? মেয়েটাকে বাঁচাতে দাও |" লোকটা মৃদু হেসে বলে মেয়েটা বেঁচে গেছে - আর ওরা যার পিছনে ধাওয়া করে গেলো সেটা মায়া | মায়াকে কেউ ধরতে পারে না | তাই তার পিছনে ওরা অনন্তকাল ধরে ছুটতে থাকবে |ওদের আর কেউ খুঁজে পাবে না ! আমি নরাধমগুলোর শেষ পরিণতি দেখানোর জন্যই তোমাকে ডেকেছি |" পলাশ চেঁচিয়ে বলে -"কে আপনি ?" লোকটার সারা গা থেকে একটা নীলাভ জ্যোতি বেরোতে থাকে , পলাশ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে |

পলাশের যখন জ্ঞান ফেরে তখন অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে | সে চোখ মেলে দেখে বড়বাবু , রবিন আর বাকি থানার কর্মীরা চিন্তিতমুখে দাঁড়িয়ে আছে | বড়বাবু বলেন " একটি মেয়ে থানাতে ঘন্টাখানেক আগে রিপোর্ট করে যে বাবিনরা ওকে তুলে নিয়ে যেতে গেলে একজন কালো মতো লোক ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জঙ্গলের ভাঙা শিবমন্দিরে ওকে লুকিয়ে রাখে | সেই লোকটিই মেয়েটিকে বলে যে ও পুলিশে খবর দিতে যাচ্ছে | ছোট জায়গা - সবাই সবাইকে চেনে ; কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো কালো লোকটিকে মেয়েটি চেনে না | খালি বলে ভারী সুন্দর তার কথাগুলো ! আমি বাবিনদের ছাড়বো না - ওরা বোধহয় এলাকা থেকে পালিয়েছে !" পলাশ অস্পষ্টভাবে বলে -"ওরা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে !"



NEW TOWN, WEST BENGAL 700159
India


No comments:

Post a Comment