কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে বিদ্ধেষভাব বাড়লেও অনেক নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি আছেন যারা চিন্তা করেন কিভাবে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানো যায়। এই সব প্রগতিশীল মানুষের প্রচেষ্টায় প্রতি বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় মংগল শোভাযাত্রা। যেখানে ফুটে উঠে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এক দারুণ চিত্র। নতুন চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য নতুন বছরের প্রথম দিন আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকল অশুভ চিন্তাকে দূরে রাখার একটা প্রচেষ্টা হচ্ছে নববর্ষ উদযাপন। এই নববর্ষ নিয়েই অনেকে সম্মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেন। আবহমানকাল হতে নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নববর্ষে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে স্নানাদি সেরে পূত-পবিত্র হয়। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়।
বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লোকজ অনেক খাবার হারিয়ে যাচ্ছে। লোকজ খাদ্য মৌসুমী পিঠা বাঙালীর প্রাচীন ঐতিহ্য। গ্রামগঞ্জের এই ঐতিহ্য অনেক ম্লান হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের বৃদ্ধ দাদি-নানি, মা-চাচি ও শৌখিন বৌ-ঝিরা এ প্রথাকে কিছুটা টিকিয়ে রেখেছেন। পিঠা শুধু লোকজ খাদ্য নয়, এটা বাংলা ও বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। পারিবারিক ও সমাজ জীবন থেকে পিঠা তৈরির প্রচলন কমে গেলেও বিভিন্ন উৎসবে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় বাড়ির বৌ-ঝিদের। বাঙালীদের জনপ্রিয় ও মুখরোচক খাবারের তালিকায় পিঠা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ভাত বাঙালীর প্রধান খাদ্য। কিন্তু খাদ্য রসিক বাঙালী সুদীর্ঘকাল থেকে ভাতের পরিপূরক, মুখরোচক আরও অনেক খাবার তৈরি করে আসছেন। নববর্ষে আয়োজনের মধ্যে চিড়া, মুড়ি, নাড়ু, খৈ এবং রকমারি পিঠাপুলির ব্যবহার অন্যতম। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত।
স্বপ্ন দেখছি ১৪২৯ সন হবে মানবতার বছর। যেখানে থাকবেনা হিংসা, বিদ্ধেষ, হানাহানি অথবা আত্ম প্রতিষ্ঠার অহংহার। সম্প্রীতি নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে মানবতা জেগে উঠবে। দুঃখী মানুষ আর পীড়িত জনের পাশে আমাদের মানবতা থাকবে। সবাই নিজ নিজ ধর্মকে ভালোসব। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে যারা উগ্রতা, হানাহানি সৃষ্টি করবে তাদেরকে ঘৃণা করব। শিশুদের উপর নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, মাদক দ্রব্যের ব্যবহার কমে যাওয়ার প্রত্যাশায় আসবে ১৪২৯ সন। ভেজাল মেশানোর প্রেমে বিভোর ব্যবসায়ী সাধারণ ভোক্তাদের নির্ভেজাল খাদ্য দ্রব্য পরিবেশন করবে। ঘুষখোরের দল চেতনা ফিরে পাবেন। আশা করি তারা ঘুষ খাবেননা। ঘুষ নিয়ে মাতামাতি, হাতাহাতি, কাড়াকাড়ি সব কিছুই হচ্ছে কখনো গোপনে আবার কখনো প্রকাশ্য। ভিক্ষুকের মতো সবার আগে ভদ্রবেশি ঘুষখোর হাত পেতে বসে থাকেন। এই ঘুষ অনেকের জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করলেও আবার ফাঁদে পড়লে ঘুষ খাওয়ার অপরাধে ভুগতে হয় কারাবাস। বাড়তি উৎকোচের ফলে সমাজে বাড়ছে বৈষম্য। অর্থের বিনিময় অযোগ্য হয়ে যায় যোগ্য। যোগ্যতার মাফকাঠি তখন হয় না বিচার। যার বেশি ঘুষ দেয়ার সামর্থ আছে তার তত কাজ বুঝে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঘুষ দিয়ে কেউ কেউ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ ঘুষ দিতে গিয়ে নিজের শেষ সম্বলটুকু হারাতে বসেছে।
চাহিদা থাকবে, আকাঙ্ক্ষাও থাকবে এর বেশি আশা করলেই লোভ। সেখান থেকেই শুরু হয় ঘুষ খাওয়া। ভাল লোক যে নাই তা নয়। ধর্মীয় এবং মানবিক মূল্যবোধ এর কারনে কেউ ফিরে থাকে। যেহেতু ঘুষের টাকায় অনেক লোভী কর্মচারী,কর্মকর্তা নিজের সংসার পরিচালিত করেন সেহেতু ঘুষ না দেয়ার কোন সুযোগ নাই। এটা ঘুষ সমাজের বড় ব্যধি। ঘুষের মাধ্যমে দেশে অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, এর মাধ্যমে চরিত্রের নীচতা ও হীনতা কঠিনভাবে প্রকাশ হয়। ঘুষে লিপ্ত ব্যক্তির ইজ্জত-সম্মান বলতে কিছু থাকে না। বড় পদের অফিসার হওয়ার পরও তাকে কেউ ভয় পায় না। এই ঘুষের কারণে মেধার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। তাই দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে ঘুষ প্রথা থেকে সবাইকে বের হয়ে যেতে হবে। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প আর সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হোক আমাদের প্রিয় দেশ। বিগত দিনগুলোতে করোনার থাবায় আমরা অনেক প্রিয় মানুষ হারিয়েছি। তাদের জন্য যে শোক করছি সেই শোককে আমরা শক্তিতে পরিণত করব।
ঘুষ আর দুর্নীতি মুক্ত হয়ে আমাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি বাড়ুক। সম্প্রীতির কথা মাথায় রেখে কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত হারানো ঐতিহ্যে ফিরে পাবার প্রচেষ্টায় আমরা নতুন উদ্যেমে কাজ করে যাব। সময়ের বিবর্তনে অনেক পুরানো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তি হয়েছে। পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্তি হয়েছে। তখন পহেলা বৈশাখ ছিল জমিদারদের পুণ্যাহের দিন। ঘোড় দৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা ওড়ানো, নৌকা বাইচ, বহুরূপীর সাজ ইত্যাদি গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলা বর্তমানে আর তেমন প্রচলিত নেই। কিছু কিছু অনুষ্ঠান হারিয়ে গেলেও নিত্য নতুন কিছু অনুষ্ঠান সংযোজিত হয়েছে। নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উৎযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনো বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যূষে নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন সাধারণত সব শ্রেণীর এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে।
তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে; আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে। সকালবেলা পানতা ভাত এবং ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার একটা রেওয়াজ বর্তমান চালু হয়েছে। অনেকগুলো অনুষ্ঠান আজকে করোনার কারণে স্থবির হয়ে গেছে। মানুষের প্রাণশক্তি অনেক হ্রাস পেয়েছে।১৪২৮ সনে অনেকে চাকুরী হারিয়েছেন। চাকুরী হারানো মানুষগুলো আবার চাকুরী পাবেন। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিশু আর ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলিতে মুখরিত হচ্ছেনা তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার প্রাণ আসুক। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এগিয়ে চলুক। যারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই কাজের সাথে সম্পৃক্ত তারা অপরাধ সম্পর্কে সচেতন হোক। কামনা করি উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির বাংলাদেশে যৌতুক থাকবেনা। যৌতুকের কাছে কোনো অসহায় মেয়ের যেন মৃত্যু না ঘটে। দেশের যে আইন আছে সে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়ুক। মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সারা পৃথিবীর মানুষ করোনামুক্ত হয়ে নতুন বছরে একে অপরের সাথে মিলনের স্বপ্ন দেখবে। সম্প্রীতিতে সমৃদ্ধ হোক নতুন বছর।
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
No comments:
Post a Comment