নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত!
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত।
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে"
পুরাতন অপরাধ যত।
উপরের পংতিগুলি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চিত্রা' কাব্যগ্রন্থের 'নববর্ষে' কবিতা থেকে নেওয়ার। নববর্ষ মানে পুরনোকে ভুলে নতুন করে শুরু, নববর্ষ মানে সকল নেতিবাচককে দূরে সরিয়ে ইতিবাচকগুলোকে কাছে টেনে নেওয়া। নববর্ষ এমন একটা উৎসব যা জাতী ধর্ম ও ভৌগলিক অবস্থান নির্বিশেষে পৃথিবী প্রায় প্রতিটা মানুষ পালন করে; তবে অবশ্যই সময়ের ভেদে। আর সেই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয় বাঁধনহারা যা কখনো কখনো উন্মাদনার পর্যায় চলে যায়। নববর্ষ নিয়ে মানুষ এতটাই আবেগপ্রবণ। কিন্তু গত দুবছর এই উৎসব বড্ড ম্যাড়মেড়ে হয়েগেছে তার কারন বিশ্বব্যাপী করোনা নামক মহামারীর প্রোকপে অর্থনৈতিক মন্দা। দুটো ঘটনা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাক যার স্থান ও পাত্র কাল্পনিক।
ঘটনা ১:
বছর সাতাশের যুবক রতন মাহাত, বাড়ি পুরুলিয়ার এক গ্রামে, বাবা দিনমজুরের কাজ করে। মা মরা ছেলে রতনকে তার বাবা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে। আজ সকালে হাটে গেছে রতন, সপ্তাহে দুদিন হাট বসে, সেখান থেকেই প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কেনে। হাটে সব্জি বাজার করে রতন গোবিন্দকাকার কাপড়ের দোকানের পাশ দিয়ে পেরিয়ে আসছে এমন সময় গোবিন্দকাকা রতনের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল, "কিরে রতন, নববর্ষ তো চলে এলো, বাবার জন্য জামা-প্যান্ট নিবি না?" রতন এটা শুনেই থমকে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে বলল, "পরে আসব কাকা, আজ সময় নেই।"
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর রতন এক বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে স্টাডি লোন নিয়ে হোটেল ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হয়। পাশ করে রাজস্থানের একটা হোটেলে চাকরিও পেয়েছিল। মাইনে ভালই ছিল। লোকের ইএমআই দিয়েও তার হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকত। চাকরি পাওয়ার পর থেকেই সে নববর্ষ ও দুর্গাপুজোতে তার বাবাকে নতুন জামা কাপড় দেয়। কিন্তু করোনার জন্য লকডাউন হওয়ায় পর্যটন শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বহু হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রতনকে চাকরি হারাতে হয়। তখন রতনের সবচেয়ে চিন্তা ছিল লোন শোধ করা। এরপর কেন্দ্র সরকার মোরাটোরিয়াম ঘোষণা করার পর সে ভেবেছিল কিছুটা সাহায্য পাবে কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো হয়, মোরাটোরিয়াম নেওয়ার ফলে ওকে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ দিতে হয়। এখন তার জমানো টাকা সব শেষ। দু'বেলা খাবার জোটানোই তার পক্ষে দায় সে বাবাকে নববর্ষের উপহার দেবে কেমন করে!
ঘটনা ২:
ঢাকা শহরতলির এক বস্তিতে থাকে জায়েজ সেখ। ফেরি করে সে কোনোরকমে দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে চারজনের সংসার টানে। কিন্তু দু'বছর আগে পর্যন্ত ওর আর্থিক অবস্থা এমন ছিল না। জায়েজ ঢাকা শহরের এক বেসরকারী বিদ্যালয়ে অস্থায়ী পিয়নের কাজ করত। যা বেতন পেত তাতে তার সংসার আরামে চলে যেত। কিন্তু লকডাউনের পর পরিস্থিতি হটাৎই বদলে যায়। প্রথম তিন মাস বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওদের বেতন দিয়েছিল কিন্তু তারপর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অনলাইন ক্লাস শুরু হয়। স্কুল থেকে ওকে জানানো হয় যে আপাতত তাকে লাগবে না। এই খবর পেয়ে ওর মাথায় বাজ পড়েছিল।
আর কয়েকদিন পর নববর্ষ। বাংলাদেশে পান্ত ভাত আর ইলিশ মাছ খেয়ে নববর্ষ উদযাপন করে। জায়েজকে তার বড় মেয়ে আবিদা ইতিমধ্যেই বলেছে, "আব্বু এবছর নববর্ষে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খাওয়াবা তো?" মেয়ের উৎসাহী চোখ দুটোর দিয়ে চেয়ে সে না করতে পারেনি। পান্তা তো আছেই কিন্তু সে জোগাড় করবে কিভাবে!
আজকের পৃথিবী জুড়ে অগুন্তি রতন আর জায়েজ রয়েছে যাদের জীবনকে করোনা নামক অভিশাপ হটাৎই আমূল বদলে দিয়েছে। গত দুবছরে সারা বিশ্বব্যাপী কোটি-কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছে, লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে। এই পুরো নীল গ্রহটাকে গ্রাস করেছে আর্থিক মন্দা। তবে এখানে শুধু ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার উপরেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে।
করোনা অতিমারি ভারতের সবচেয়ে যে দুটো সেক্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা হলো পর্যটন ও বেসরকারি বিমান পরিবহন। ভারতের মোট দেশীয় পণ্য বা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি)-এ শিল্পের অবদান যথাক্রমে ৯.২% ও ২.৪%। ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে ভারতবর্ষে প্রথম ৪.৩ কোটি মানুষকে সেবা প্রদান করেছে পর্যটন শিল্প যা ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ আর্থিক বছরে তলানিতে এসে ঠেকেছে, আনুমানিক ৩.৮ কোটি অর্থাৎ ৭০% কমেছে। ফলে এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত কয়েক কোটি মানুষের হয় রোজগার বন্ধ হয়েছে অথবা ব্যাপক হারে হ্রাস হয়েছে। এছাড়াও লকডাউন ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন কোভিড বিধি লাগু করার ফলে পরিবহন শিল্প ও তার পরিপূরক পেট্রোলিয়াম শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
করোনার প্রকপে লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর প্রথম তিন সপ্তাহে ভারতের প্রতিদিন ৩২ হাজার কোটি টাকা করে লোকসান হয়েছে। জাপানের আর্থিক অধিষ্ঠিত কোম্পানী 'নমুরা'র হিসেব মতো ভারতের আর্থিক কর্মকান্ড ২২শে মার্চ, ২০২০ তে যেখানে ছিল ৮২.৯ একক তা সে বছর ২৬শে এপ্রিল নেমে আসে ৪৪.৭ এককে। বেকারত্বের হার সে বছর ১৫ই মার্চ যেখানে ছিল ৬.৭% তা ১৯শে এপ্রিল গিয়ে দাঁড়ায় ২৬%। হটাৎ করে ঘোষিত লকডাউনের ফলে ভারতবর্ষের প্রায় ১৪ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পরে আরও বহু মানুষের বেতন হ্রাস হয়।
ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম (চীনের পরেই) যেখানে ১৫ লক্ষ স্কুলে ৯৭ লক্ষ শিক্ষক শিক্ষিকা আনুমানিক সারে ২৬ কোটি ছাত্র-ছাত্রীকে পড়ায়। যদিও এহেন একটি বিরাট শিক্ষা ব্যবস্থাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দিয়েছে এই অতিমারি। যার কারন স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি। অতিমারির জন্য লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুরু হয় অনলাই ক্লাস। যদিও ভারতবর্ষের এক শ্রেণী মানুষের কাছে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট নিতান্তই বিলাসিতা। ফলে সেই সব ঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় সেখানেই ইতি পরে যায়।এছাড়াও কর্মহীন হয়ে পরা ঘরের ছেলেমেয়েরাও পরবর্তীতে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে কাছের খোঁজে বেড়িয়ে পরে। ফল স্বরূপ সম্প্রতি স্কুল পুনরায় খোলার পর দেখা গেছে অন্তত ১৭% ছাত্র-ছাত্রী আর স্কুলে ফেরত আসেনি। ভারত সরকারের শিক্ষা দপ্তরের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ভারতে ৩৫ লক্ষ ছেলেমেয়ে স্কুলের গণ্ডির বাইরে যা সত্যিই উদ্বেগজনক তথ্য।
একদিকে করোনার কারনে রোজগারে কোপ আর একদিকে বিভিন্ন কারনে বর্ধিত মূল্যবৃদ্ধি- এই দুইয়ের সাঁড়াসি আক্রমণে প্রাণ ওষ্ঠাগত মানুষগুলো নববর্ষের উৎসব কি আদেও পালন করতে পারবে? তাদের কাছে এই দিনটা কি আর আলাদা কোনো গুরুত্ব রাখে? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন নববর্ষের নতুন প্রভাতে আর্থিক মন্দার এই কালো মেঘ কেটে গিয়ে আবার সুদিনের নতুন সূর্য উদয় হয়।
পূর্ব বর্ধমান
No comments:
Post a Comment