প্রকাশ অসহায়ের মত মাথা নেড়ে উত্তর দেয়, ‘এই অবস্থাটা না গেলে এখন কোন অ্যাম্বুলেন্স ওদিকে যাবে না। কয়েকটা গাড়ির সাথে কথা হল কিন্তু অনেক টাকা চাইছে। দেখি বাচ্চুদার সাথেই কথা বলতে হবে।’
বাচ্চুদার নামটা শুনেই পিয়ালির মুখটা ছোট হয়ে যায়। এপাড়াতে লোকটার খুব বদনাম। অনেক বাজে ব্যবসার সাথে যুক্ত সঙ্গে আবার সুদের ব্যবসাও করে। নিজের ঘরে মধুচক্রের আসরও বসায়। ওর সাথে কথা বললেও লোকজন অন্য চোখে দেখে।
তার কাছে কোন কিছু বন্ধক রেখে টাকা ধার!
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে পিয়ালি। কয়েকদিন আগে সম্রাট বাড়ির সামনেটাতে পায়চারি করতে গিয়ে পড়ে যায়। একটা ফোন আসায় পিয়ালি অল্প সময়ের জন্য ঘরের ভিতরে এসেছিল। পাড়ার একটা মেয়ে ছুটে পিয়ালিকে ডেকে নিয়ে যায়।তারপর দুজনা মিলে সম্রাটকে ঘরে আনে।ডাক্তারবাবুকে ফোন করতেই উনি বলেন, ‘বলেছিলাম তো সমস্যা আরো বাড়বে, তাড়াতাড়ি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।’
-অপারেশন!
কিন্তু এই ভয়ঙ্কর সময়ে নিয়ে যাবো কিভাবে?এখানকার কোনো হাসপাতাল তো রুগীই নিচ্ছে না।বাইরের রাজ্যেও নাকি একই অবস্থা।
কথাগুলো মেজো ভাসুরকে বলতেই উনি গাড়ির খোঁজে বেরিয়ে ছিলেন।
এই পাড়াতেই বড় ভাসুর স্বপনের শ্বশুরবাড়ি।শাশুড়ি কয়েকটা কাঁচা আম নিয়ে দিতে যাবার সময় বলে গেলেন, ‘ছোটবৌমা, মেজবৌমা বাজার থেকে না ফিরলে ভাতের জলটা একটু চাপিয়ে দেবে।’
‘আর ভাতের জল! মনে হচ্ছে এক গামলা বিষ তিনজন খেয়ে এক্কেবারের জন্য শেষ হয়ে যাই।’
এসব কথা তো আর মুখে বলা যায় না। প্রকাশ ঘরের ভিতরে ঢুকতেই একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, ‘কাল কি একবার কাউন্সিলারের অফিসে যাবো, কিছু যদি ব্যবস্থা করা যায়?’
–এটা না কাটলে কিচ্ছু হবে না।আমি গতকাল বিকালের দিকে মেয়রকে ফোন করে সব জানাতে বলেছিলাম। আমাদের প্রেসের অমূল্যদা সব শুনে নিজেই ফোন করবার কথা বললেন।এম.এল.এ সাহেবকে জানাবার কথাও বলেছেন।এটা না মিটলে কিছু হবে না।পারমিশন বের করে নিলেও কোন হাসপাতাল এই সময় অপারেশন করবে না।
‘আমি ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলেছি, উনি একটা ব্যবস্থা করে দেবার কথা দিয়েছেন, কিন্তু বাইরে যেতে হবে। ওখানে সরকারি হাসপাতালে সেরকম কোন খরচা নেই।’ পিয়ালি উত্তর দিল।
-তোকে এখন এই সব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।আমি দেখছি, তুই রেস্ট নে। সম্রাটের কথা শুনে প্রকাশও উত্তর দেয়।
পিয়ালি আবার বলে উঠল, ‘তুমি কি এখন স্নান করতে যাবে, না একটু পরে ….’
–পরে, আমি একটু দেখি আমাদের প্রেস ক্লাবে কতটা কি ব্যবস্থা করতে পারল ?
পিয়ালি কোন কথার উত্তর না দিলেও বুঝতে পারল মানুষটার কথাগুলোও এবার জড়িয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ল, ‘যখন বুঝতে পারবেন কথা খুব জড়িয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ করে রেগে যাচ্ছেন অথবা চোখে দেখতে বা কানে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে তখন বুঝবেন রোগটা আস্তে আস্তে সিভিয়ার হয়ে যাচ্ছে। এরপর আস্তে আস্তে হাঁটতে চলতে অসুবিধা হতে আরম্ভ হবে, মাথা ব্যথা তো আছেই। তখন কিন্তু ইমিডিয়েট অপারেশন না করালে বাঁচানো যাবে না। তবে আপনাকে একথাও বলে রাখা দরকার অপারেশন মানেই কিন্তু উনি ঠিক হয়ে যাবেন, আগের মতই সব কিছু করতে আরম্ভ করবেন এমন ভাবনা মনে আনবেন না।আর যদি ওটা ম্যালিগন্যান্ট হয় তবে কিন্তু চান্স...’ ‘তারমানে!’ থামিয়ে দিয়েছিল পিয়ালি।
ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,‘খরচ কিরকম হতে পারে কিছু বলতে পারবেন?’
-খরচ! এখানে সরকারি হাসপাতালে করালে হয়ত একটু কম, কিন্তু কতটা তাড়াতাড়ি হবে বলা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ হল বাইরে কোথাও নিয়ে চলে যাওয়া। সেক্ষেত্রে বেসরকারিতে করালে হাতে তিরিশ নিয়েই নামতে হবে।
-তিরিশ লাখ!
আঁতকে উঠেছিল পিয়ালি। প্রকাশ তখন বাইরের জেলার একটা কারখানাতে কাজ করে। ফোনে পিয়ালির মুখে সব শুনে ওপার থেকে ‘তুমি কিছু চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি।’ কথাগুলো শুনতে পেলেও পিয়ালি জানে ভাসুরের কথাগুলো শুধুই প্রাথমিক সান্ত্বনা। তিরিশ লাখ জোগাড় করা মুখের কথা নয়। তাও বাড়ি ফিরেই নিজের সম্বলের একটা ফিক্সট ডিপোসিট ভাঙিয়ে পুরো টাকা পিয়ালির হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘এখন একলাখ রাখো, অফিসে লোনের জন্য বলেছি, দেখি আরো হয়ত একলাখ জোগাড় হবে।’
পিয়ালি প্রথমে নিতে চাইনি। মেজোভাসুরেরও নিজের সংসার আছে। ছেলে বেসরকারি স্কুলে পড়ে। ক্রিকেট খেলাও শিখছে, বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যায়, এখন সেসবেরও খরচ আছে, তাছাড়া সংসারের খরচ তো আছেই। শাশুড়ির বয়স হচ্ছে।
মেজো’জা তারপর সব কিছু শুনে বলে, ‘প্রয়োজনে আমিও কিছু করবো গো, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।আগে ভাইয়ের শরীর ঠিক হোক। সেরকম হলে পরে দিয়ে দেবে।’
পিয়ালির বাপের বাড়ির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। তাও তাদের কাছে পিয়ালি নিজের থেকেই বলেছে। হাজার পঞ্চাশ দেবেও বলেছে।
কিন্তু বাকি টাকা! ট্রেন বন্ধ, এরোপ্লেন বন্ধ, শুধু গাড়ির ভরসায় যেতে হবে। সেখানেও ভাড়া খুব কম করে হলেও পঞ্চাশ ষাটের কম হবে না।তারপর ওখানে থাকা খাওয়া, চিকিৎসার কি খরচ সেসব তো কিছুই জানা নেই। ওষুধেরও খুব দাম।সম্বল বলতে কয়েক ভরি গয়না। তাও ব্যাঙ্কে গেলে সেরকম টাকা পাওয়া যাবে না। একমাত্র ওই বাচ্চুদা।
তাও ভালো, মেজো ভাসুর এই অবস্থাতেও চেষ্টা করছে, বড়ো ভাসুর তো সব কিছু শুনে বাড়িতে আসাই বন্ধ করে দিল। অথচ এখনো প্রতি সপ্তাহে শ্বশুরবাড়ি আসে। রাতে থাকে, পিয়ালির শাশুড়ি দেখাও করতে যায়। কবে নাকি ওখানেই বলেছে, ‘মা, আম পড়লে ও’বাড়িতে দিয়ে যাবে তো।’
রান্না ঘরে ভাতের জল চাপাতে গিয়েও মন পড়ে থাকল। লোকটা এক্ষুণি নামতে গিয়ে কিছু না বিপদ করে ফেলে। চাল ফেলেও একবার দরজার আড়াল থেকে সম্রাটকে দেখে। সম্রাট তখন খোলা জানলার পাশে বসে বাইরে চোখ দুটো রেখে বসে ছিল। এবারে গরমাটাও পড়েছে, তার উপর কোথা থেকে এই এক রোগ এল, সব কিছু এক্কেবারে বন্ধ।বাজার খুলছে সারাদিন মাত্র দুঘন্টার জন্য।ওষুধের দোকান পর্যন্ত সবসময়ের জন্য খোলা থাকছে না। দু’দিন আগেই প্রকাশ সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে শহরের সব বড় বড় হাসপাতালে সম্রাটকে ভর্তি করবার জন্য ঘুরেছে। কয়েকটা হাসপাতাল তো কথাই বলল না।একটা যাও বা ডাক্তারের ফিস নিয়ে কথা বললেও সব রিপোর্ট দেখে মুখের উপর বলে দিল, ‘এটা তো বাইরের পেসেন্ট, বলুন এই অবস্থায় আমরা কেন রিস্ক নিয়ে ভর্তি করে অপারেশন করবো?’
প্রকাশ অনেক করে বলবার পরে কিছু না হতে দেখে প্রেসের ভয় দেখায়। ডাক্তারটা মুখের উপর বলে দেন, ‘ওসব প্রেস আমার পকেটে থাকে। বেশি বকলে ঘাড় ধরে বের করে দেবো।’
বাড়িতে এসে পিয়ালিকে সব কথা বলতে পারেনি। যে কটা কথা বলতে পারল সেসব শুনেই পিয়ালির চোখে জল বেরিয়ে এল। সেদিনই সম্রাটের ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে উনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল সিরিয়াস ছাড়া ভর্তি নেবে না।নাসিংহোম নিলেও খরচ তো.....।তারপরে আপনারদের জেলা এখন রেড জোনে।’
-তাহলে কি কোন উপায় নেই? চোখের সামনে মানুষটাকে মরতে দেখতে হবে।
শেষের কথাগুলো শুনেই ডাক্তারবাবু বাইরের রাজ্যের একটা সরকারী নার্ভের হাসপাতালের ঠিকানা ও ওখানকার এক ডাক্তারবাবুর ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযাগ করেতে বলেন। সব রিপোর্ট পাঠিয়ে দিতে বলেন সঙ্গে অবশ্য এটাও বলে দেন,‘খারাপ কিছু হলে কিন্তু...।’
দুদিন পর ডাক্তার বাবু নিজেই ফোন করে সব সিম্পটম নেন। ভিডিও কল করে সম্রাটের সাথে কথা বলেন, হাঁটতে বলেন। শেষে পেসেন্ট নিয়ে যেতে বলেন।
পিয়ালি সব শুনে একটু আশার আলো দেখলেও ভাবতে থাকে,‘যাবে কিভাবে?’
সম্রাটই নিজে এরপর প্রেসের লোকের মাধ্যমে একটা পারমিশনের ব্যবস্থা করলেও মাথার উপর ভয় চেপে বসে। এতোটা রাস্তা, একটা অ্যাম্বুলেন্সের সাথে কথা হয় কিন্তু ব্যাটা এত বদমাশ এক লাখ টাকা ভাড়া চাইছে।
-এক লাখ! এতো অসম্ভব।
প্রেসের সবার সাথে কথা হয়। অবশ্য লোকাল প্রেস, সম্রাট ঐ প্রেসে অ্যাড কালেক্টার হিসাবে কাজ করে, আর টুকটাক খবর দেয়। কিন্তু সে আর এমন কি? কোন রকমে নিজেদের সংসার খরচটা হয়। বাড়িতে মায়ের ওষুধের জন্যও কিছু দিতে হয়, নিজেরও বিয়ের বেশ কয়েকবছর পর ছেলে হল, তার আগে বৌকে অনেকদিন ধরে ডাক্তারও দেখাতে হয়।তার উপর এই বিপদ।কোথাও কিছু নেই, একদিন বাড়ি ফিরে পায়ের পেশিতে কেমন যেন টান লাগে। সেই সঙ্গে মাথায় হাল্কা ব্যথা।প্রথমদিকে ডাক্তারের কাছেও যায় নি। পিয়ালিকেও বলেনি। ভেবেছিল এমনি ব্যথা, পরের দিন কমে যাবে। পরের দিন কমে গেলেও কয়েকদিন পরে আবার ব্যথা। সেই সঙ্গে একটা বমিবমি ভাব। বাইক চালানোর সময় মাঝে মাঝেই পেশীতে কেমন যেন টান ধরে যাচ্ছিল। বাড়ি ফিরে পিয়ালিকে বলতেই পিয়ালি ডাক্তার দেখাতে বলে।কিন্তু দেখাবে কিভাবে? পিয়ালি তখন নিজেই প্রেগন্যান্ট। সেই ট্রিটমেন্টের যা খরচ হচ্ছে তাতেই ফতুর হয়ে যাবার মত অবস্থা। সম্রাট এড়িয়ে চলছিল। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এত বেশি মাথা ব্যথা করতে আরম্ভ করল আর এড়িয়ে থাকা গেল না।ডাক্তার দেখাতেই হল। প্রথমে সাধারণ মেডিসিনের ডাক্তার, সেখান থেকে নিউরো। সিটি স্ক্যানেই পুরো ব্যাপারটা ধরা পড়ে, ডাক্তার আরো খারাপ কিছুর সন্দেহ করেন। ততদিনে ছেলেটার বয়স ন’মাস হয়ে গেছে।
একেকটা দিন কাটছে আর পিয়ালির মন ভয়ে আরো অস্থির হতে আরম্ভ করেছে। রাতে ঘুম হয় না, মাঝে মাঝেই সম্রাটের নাকের নিচে হাত দিয়ে দেখে মানুষটা বেঁচে আছে কিনা? ডাক্তারবাবু প্রতিদিন একটু একটু করে হাঁটতে বললেও একা ছাড়তে সাহস হয় না। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে অন্ধকারেই ব্যাঙ্কের বই আর নিজের যা কিছু সোনা দানা আছে বের করে হিসাব করতে আরম্ভ করে।কিন্তু কোথাও কিছুর কিনারা হয় না। শেষকালে সব হিসাব করা বন্ধ করে দেয়। রাতের অন্ধকারে শুধু লম্বা শ্বাস মিশতে থাকে। বাইরের ডাক্তার বাবুকে ফোন করলেই উনি সব দেখে শুনে প্রতিদিনই বলছেন, ‘এখন শরীর অনেকটাই স্টেবল, এইসময় অপারেশনটা করিয়ে নিন। আরো ডিটোরিয়েট করলে সব দিক থেকে অসুবিধা হবে।’
-সে তো হবেই।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের একবছরের ছেলেটার মাথায় হাত বোলায়। ভিতরটা তখনই উথাল পাথাল করতে আরম্ভ করে। কয়েকদিন পরেই প্রকাশকে বলে, ‘দাদা, আপনি গাড়ির সাথে একটা ফাইনাল কথা বলে নিন। অপারেশনটা তাড়াতাড়ি করিয়ে নিতে হবে।’
-কিন্তু ও তো অনেক টাকা বলছে। এতো টাকার ব্যবস্থা কি করে হবে?
একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে পিয়ালি। সম্রাটের দিকে তাকাতেই কান্না আসে। পিয়ালি আস্তে আস্তেই বলে, 'যা গয়না আছে বাচ্চুদাকেই বন্দক নিয়ে দেখি। একটু বেশি দেবে তো। ব্যাঙ্কে তো ঘুরে এলেন।’
–সে দেবে, কিন্তু ওর কাছে যাবে কে ? তুমি বা আমি যে যাবো, লোকে ..
–যে যা ভাবে ভাবুক।ওকে বাঁচানোর জন্য আমাকে যদি আরো নিচে নামতে হয়...’
অন্ধকার আকাশে বিকাল থেকেই মেঘ জমছিল।মেঘ জমলে মাঝে মাঝে আকাশটা কেমন যেন চকচকে হয়ে যায়। পিয়ালি জানলার পাশে সেদিকেই চোখ রেখে দাঁড়ায়।বিছানায় শুয়ে ছিল সম্রাট, আর তার পাশে এক বছরের ছেলেটা।
B1-85/1, V.K.Nagar
M.A.M.C, Durgapur-713210
Paschim Bardhaman
No comments:
Post a Comment