প্রশাসনিক কারণে অথবা সময়ের তাগিদে ভূখণ্ড দ্বিধাবিভক্ত হয়, একখানা বৃহৎ সাম্রাজ্য ভেঙে গঠিত হয় অজস্র খণ্ড-রাজ্য । কিন্তু ইতিহাস-টা অখণ্ড, অপরিবর্তনীয় থেকে যায় । কখনো-সখনো সেই খণ্ড খণ্ড ভূখণ্ড বৃহত্তর সংহতির প্রয়োজনে সেলাই করে জুড়ে ফেলতে চাইলে এই ইতিহাস-টাই হয়ে ওঠে অন্যতম হাতিয়ার । ভূগোল কি বদলায় ! অনেকেই হয়তো ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছেন, পশ্চিম বঙ্গের শস্য ভান্ডার বলা হয় বর্ধমান জেলা-কে । ধান এ জেলার প্রধান ফসল, এ ছাড়া গম, পাট, আলু, পেঁয়াজ, আখ উৎপাদিত হয় প্রচুর পরিমাণে, এই জেলার রানিগঞ্জ এবং আসানসোল কয়লাখনির জন্য প্রসিদ্ধ, দুর্গাপুরে আছে লৌহ-ইস্পাত কারখানা, জেলা সদর বর্ধমান থেকে অল্প দূরে কাঞ্চন নগর ছুরি, কাঁচির জন্য প্রসিদ্ধ, ধাত্রিগ্রাম তাঁতের কাপড়ের জন্য প্রসিদ্ধ ইত্যাদি । সুতরাং আজকের দুই বর্ধমানের মানুষ নিঃসঙ্কোচে বলতেই পারেন, “ভূগোলে ইতিহাসে আমরা এক” (অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত) ।
‘Burdwan’ নামটি সংস্কৃত বর্ধমান থেকে ইংরেজ-রা রেখেছিল । গলসি থানা সংলগ্ন ‘মল্লসরুল’ গ্রামে প্রাপ্ত ষষ্ঠ শতকের একটি তাম্রলিপিতে প্রথম নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় । নামকরণটির উৎস সম্পর্কে দুটি মত রয়েছে — প্রথম মতানুযায়ী, নামটি ২৪ তম জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমানস্বামী-র নামানুসারে প্রণীত হয়েছে । জৈন কল্পসূত্রাণুসারে, মহাবীর কিছুসময় অস্তিকগ্রামে কাটিয়েছিলেন, যা পরে বর্ধমান নামে পরিচিত হয় । অন্য মত হল, বর্ধমানা-শব্দের অর্থ সম্পন্ন কেন্দ্র । গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য সভ্যতার বিকাশের সময়ে, সমৃদ্ধি ও সম্পন্নতার প্রতীক হিসেবে এই স্থান ছিল প্রসিদ্ধ । রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সুবা-কে উনিশটি সরকারে ভাগ করেন । আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’-থেকে জানা যায়, সেকালে মুঘল শাসকদের কাছে বর্ধমান পরিচিত ছিল শরিফাবাদ নামে, সেই সময় বীরভূমের দক্ষিণাংশ, মুর্শিবাদ জেলার কান্দি আর বর্ধমান জেলার মধ্য অংশ জুড়ে এর সীমানা ছিল । ১৭৪০ সালে ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠা আক্রমণের পর মুঘল কর্তৃক প্রথম ‘রাজা’ খেতাব প্রাপ্ত হন চিত্র সেন রায়, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন । তিনিই কালনার বিখ্যাত 'অম্বিকা-কালনা' সিদ্ধেশ্বরী মন্দির (১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে) নির্মাণ করেন । তাঁর মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের ফরমানে বর্ধমানের ‘রাজা’ হন তাঁর নিকট আত্মীয় তিলকচাঁদ । রাজা তিলকচাঁদ ছিলেন বর্ধমানের প্রথম মহারাজাধিরাজ, চিত্র সেন রায়ের তুলনায় বৃহত্তর এস্টেটের শাসনকর্তা । তাঁদের বংশের অন্যতম রাজারা হলেন প্রতাপচাঁদ ও বিজয়চাঁদ মেহতাব । ১৭৬০ সালে মীরকাশিম বর্ধমান জেলা ব্রিটিশ সরকারকে হস্তান্তর করেন । বর্ধমান শহর জেলার জেলাসদরে পরিণত হয় । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই শহরের যোগদানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে । ১৯৫৫ সালে জমিদারি উচ্ছেদ হলে বর্ধমান রাজের অবলুপ্তি ঘটে । বর্তমানে বর্ধমান পশ্চিমবঙ্গের একটি দ্রুত উন্নয়নশীল বাণিজ্যকেন্দ্র । ২০১৭ সালের ৭ ই এপ্রিল আদি বর্ধমান বিভক্ত হয় ও পশ্চিমবঙ্গের ২৩ তম জেলা রূপে পশ্চিম বর্ধমানের জন্ম হয় । সাধারণত দেখা যায়, যিনি কখনো বর্ধমানে পা ফেলেন নি, তিনিও বর্ধমানের সুপ্রসিদ্ধ মিহিদানা ও সীতাভোগ-এর নাম শুনেছেন । এবং বর্ধমানে গেলেই সর্বাগ্রে এই দুটি বস্তু তিনি চেখে দেখবেনই ।১৯০৪ সালে বড়লাট জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জন বর্ধমানের জমিদার বিজয়চাঁদ মেহতাবকে ‘মহারাজা’ খেতাব দিতে বর্ধমান ভ্রমণ করেন । কার্জনের বর্ধমান আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে বিজয়চাঁদ বর্ধমানের জনৈক মিষ্টি প্রস্তুতকারক ভৈরবচন্দ্র নাগকে একটি বিশেষ মিষ্টি প্রস্তুত করতে বলেন । ভৈরবচন্দ্র নাগ বর্ধমানের দুই বিখ্যাত মিষ্টান্ন সীতাভোগ ও মিহিদানা তৈরী করেন । বলাইবাহুল্য কার্জন সীতাভোগ খেয়ে অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন ।
এই বর্ধমান সত্যিই রত্নগর্ভা । ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্য বিশারদ সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২) থেকে শুরু করে বঙ্গ সাহিত্যের অগণ্য খ্যাতনামা প্রতিভার জন্মস্থান বর্ধমান । একদা চৈতন্য-সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে পরিচিত বর্ধমানের কুলীনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মালাধর বসু । ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ভাগবতের দশম-একাদশ স্কন্ধের অনুবাদ করেন । তৎকালীন গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক্ শাহ্ তাঁকে গুণরাজ খাঁ উপাধি দেন । স্বয়ং চৈতন্যদেব মালাধরের পয়ার-ত্রিপদীর উচ্চ প্রশংসা করেছেন । তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যেই শ্রীকৃষ্ণ-কে সর্বপ্রথম ‘প্রাণনাথ’ সম্বোধন করা হয় ।
ষোড়শ শতকে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্ধমান জেলার দামুন্যা (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ‘দামিন্যা’) গ্রামে । ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে বাস্তুচ্যুত হয়ে আনুমানিক ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দ চক্রবর্তী পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে আশ্রয় নেন, সেখানে জমিদার বাঁকুড়া রায়ের কাছে আশ্রয় পান । তাঁর কাব্য সাধারণভাবে ‘অভয়ামঙগল’ নামে পরিচিত ।বৈষ্ণব পদাবলি ও চৈতন্য জীবনী-কাব্য বাদ দিলে মধ্যযুগে মৌলিক প্রতিভার গৌরব সবচেয়ে বেশী যাঁর, তিনি মুকুন্দ চক্রবর্তী । তাঁর কবি-মানসের সাথে আধুনিক মননের আত্মীয়তা লক্ষ করেই সাহিত্যের সমালোচকেরা মন্তব্য করেছেন, এ যুগে জন্মগ্রহণ করলে তিনি ঔপন্যাসিক হতেন । এমন জীবনরসরসিক, মানবতাবাদী কবি মধ্যযুগের প্রেক্ষাপটে সত্যিই দুর্লভ ।
পদাবলির ‘চন্ডীদাসের ভাবশিষ্য জ্ঞানদাস চৈতন্যোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি । আত্মপরিচয় বর্ণনাংশে কবি লিখে গিয়েছেন, রাঢ়দেশের কান্দরা (তথা, কাঁদড়া) গ্রামে তাঁর জন্ম । বর্ধমানের কাটোয়ার প্রায় দশ মাইল পশ্চিমে ঐ গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম । সেকালে কাব্যবীণায় সহজ সরল সুরে গীতিঝংকার তুলে তিনি পাঠকের হৃদয় অক্লেশে জয় করেছিলেন । জ্ঞানদাস লিখেছিলেন, —
“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর ।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে ।
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে ।।”
- সমালোচক সাধে বলেন নি, রক্তের অনু-পরমানুর এতো মহৎ গীতিক্রন্দন সাহিত্যে দুর্লভ ! ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য’ কবি গোবিন্দদাস ছিলেন ভক্ত, সাধক, পন্ডিত ও কবি । অসাধারণ পান্ডিত্য ও ব্রজবুলি ভাষায় তাঁর অসামান্য প্রতিভার যুগলবন্দিতে অভিসার ও মাথুর লীলার বৈষ্ণব পদগুলিতে তিনি শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন । কবি গোবিন্দদাস ভূমিষ্ঠ হন কাটোয়ার বৈদ্যপ্রধান গ্রাম শ্রীখণ্ডে, তাঁর মাতুলালয়ে, ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে । যদিও তাঁর পিতৃনিবাস ছিল কুমারনগরে । বৈষ্ণব সমাজে যিনি ‘চৈতন্যলীলার ব্যাস’ নামে খ্যাত, সেই বৃন্দাবন দাসের জন্ম বর্ধমানের দেনুর গ্রামে । তিনি ‘শ্রীচৈতন্য-ভাগবত’ নামে চৈতন্য জীবনী কাদ্য রচনা করেন । তিন খন্ডে বিভক্ত এই সুবৃহৎ কাব্যে সারল্যের সাথে আশ্চর্য লোকচরিত্র-জ্ঞানের পরিচয় মেলে । শ্রীচৈতন্যের মানবমূর্তি ও ভাগবতমূর্তি -- দুদিকেই তিনি সমানুপাত রক্ষায় সমর্থ হয়েছিলেন ।
অকৃতদার আদর্শ বৈষ্ণব কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী কাটোয়ার নিকটবর্তী ঝামটপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । সমস্ত বৈষ্ণব তত্ত্বকথা কবি কৃষ্ণদাস তাঁর ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন । চৈতন্য জীবনের গভীর তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য - পরিণাম এই গ্রন্থের বাষট্টি-টি অধ্যায়ে (তিন খন্ড মিলিয়ে) বর্ণিত হয়েছে । কাব্য ও দর্শনের এমন যুক্তবেণী মধ্যযুগীয় ভারতীয় সাহিত্যে-ও দুর্লভ । চৈতন্য জীবনী গ্রন্থের আরেক প্রণেতা কবি জয়ানন্দ ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন, যে কাব্যে চৈতন্য প্রভুর তিরোধানের বাস্তব-ঘেঁষা বিবরণ চিত্রিত রয়েছে । বর্ধমান শহরের নিকটবর্তী আমাইপুরা গ্রামে (এই গ্রামের বর্তমানে অস্তিত্ব নেই) জয়ানন্দ জন্মগ্রহণ করেন ।
কবি কাশীরাম দাস (পৈতৃক উপাধি ‘দেব’) বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে রচিত কাশীরামের ‘ভারতপাঁচালী’ মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা অনুবাদ, যে গ্রন্থ তাঁকে আপামর বাঙালি হৃদয়ে নিত্যস্মরণীয় করে রেখেছে । মধু-কবি তাই লিখে গিয়েছেন, “হে কাশী, কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান ।” তিনি মহাভারতের অমৃততুল্য স্বাদ বাঙালি তথা সমগ্র জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন ।
ধর্মমঙ্গল-কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রাঢ় দেশের ‘জাতীয় মহাকাব্য’ আখ্যা দিয়েছিলেন । সেই ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার দুই কৃতবিদ্য স্রষ্টা রূপরাম চক্রবর্তী ও ঘনরাম চক্রবর্তী বর্ধমানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন । বর্ধমান জেলার কাইতি শ্রীরামপুর গ্রামে রূপরামের জন্ম ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, নিপুণ চরিত্রসৃষ্টি ও সাবলীল বর্ণনায় তিনি এই ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি । ঘনরাম দামোদর নদের তীরে কুকুড়া কৃষ্ণপুর গ্রামে জন্মেছিলেন । তিনি ১৭১১ সনে ‘অনাদিমঙ্গল’ কাব্যটি রচনা করেন, এই গ্রন্থে পুরাণ ভাগবত ও মহাকাব্যগুলিতে অগাধ জ্ঞানের পরিচয় মেলে । তাঁর ভনিতায় উক্ত গ্রন্থের অপর নাম ‘শ্রীধর্ম সংগীত’ । আবার সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বর্ধমান জেলার সেলিমাবাদ পরগনার কাঁদড়া গ্রামে জন্মেছিলেন মনসামঙ্গল কাব্যধারার কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ । কেতকাদাস তাঁর উপাধি । দেবী মনসার কেয়াপাতায় জন্ম বলে তিনি ‘কেতকা’, কবি তাঁর দাস । চাঁদ সদাগরের বানিজ্যপথ বর্ণনায় তিনি আশ্চর্য ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন ।
শাক্ত-কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম বর্ধমানের অম্বিকা-কালনায়, অষ্টাদশ শতকের সপ্তম দশকে । তিনি বর্ধমানের মহারাজ তেজশচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন, কোটালহাট ছিল তাঁর সাধনপীঠ । কবির মনোভাব ছিল বড়ো উদার, শ্যাম ও শ্যামা-কে তিনি শাক্তপদে একীভূত করেছিলেন । বাঙালি মায়ের কন্যাবিরহ মেনকা-র চরিত্রে চমৎকার পরিবেশন করেছেন কমলাকান্ত ।
বাংলা খেয়াল গানের প্রবর্তক, গীতিকার ও কবি, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষার পণ্ডিত রঘুনাথ রায় ‘অকিঞ্চন’ (১৭৫০-১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দ) ছদ্মনামে তাঁর প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন । ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার চুপি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত ‘বাঙ্গালির গান’ গ্রন্থে রঘুনাথ রায়ের ৯৯টি গান সংকলিত হয়েছে ।
মধ্যযুগের সুবিস্তীর্ণ কাব্যক্ষেত্র অতিক্রম করে আধুনিক সাহিত্যে প্রবেশ করলেও দেখা যাবে, একাধিক কবি-সাহিত্যিক বর্ধমানের সূতিকাগারে জন্মেছেন । কালনা মহকুমার চুপি গ্রামে প্রাবন্ধিক অক্ষয়কুমার দত্তের (১৮২০ - ১৮৮৬) জন্ম । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৮ - ১৯৭৬) বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই চালিয়ে, পৌরুষদীপ্ত রুদ্রভাবের কবিতা লিখে নজরুল বাংলাসাহিত্যে নতুনত্বের সূচনা করেন । বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ ছাত্র রাজশেখর বসু অর্থাৎ ‘পরশুরাম’ শক্তিগড়ের নিকটবর্তী বামুনপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন । বাগ-বৈদগ্ধ্য ও উইটের মারপ্যাঁচে ছোটোগল্পের পাশাপাশি ‘চলন্তিকা’ অভিধান, সরস রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদ রচনায় পরশুরাম অনন্য নজির রেখে গিয়েছেন । রবীন্দ্রানুসারী কবি কালিদাস রায় (১৮৮৯ - ১৯৭৫) বর্ধমানের কড়ুই গ্রামে জন্মেছিলেন, বৈষ্ণব কবি লোচনদাস ঠাকুর ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ । তিনি কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব এবং মেঘদূতের অনুবাদ করেন । কবি ও শিক্ষাবিদ কুমুদরঞ্জন মল্লিক ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কোগ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন । নাট্যকার, নাট্য পরিচালক এবং শ্রদ্ধেয় অভিনেতা শ্রী অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় আসানসোলের রোপো গ্রামে জন্মেছিলেন । ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাসের রচয়িতা শৈলবালা ঘোষজায়া বর্ধমানের সরাইটিকরের বাসিন্দা কুঞ্জবিহারী-হেমাঙ্গিনী নন্দীর ছয় সন্তানের অন্যতম, জন্ম যদিও চট্টগ্রামের কক্সবাজারে ।
এছাড়াও, প্রাচীন বঙ্গদেশের একজন সুবিখ্যাত ধর্মশাস্ত্র রচয়িতা ভবদেব ভট্ট, আঠেরো’শ শতকের মহিলা পন্ডিত, চিকিৎসক ও বৈয়াকরণিক হটু বিদ্যালঙ্কার, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধা এবং আইন ব্যবসায়ী যাদবেন্দ্রনাথ পাঁজা, অগ্নিযুগের আরো দুই বিপ্লবী শ্রদ্ধেয় শ্রী রাসবিহারী বসু ও সুবোধ চৌধুরী, কৃতী সাহিত্যিক রেভারেন্ড লালবিহারী দে, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ বিনয় চৌধুরী প্রভৃতি-ও বর্ধমানের সন্তান । তাই সবমিলিয়ে বর্ধমান জেলা সত্যই রত্নগর্ভা, বিশেষত বর্ধমান-কে বঙ্গসাহিত্যের সূতিকাগার বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হয় না ।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করা যাক । একদা বর্ধমানে মহারাজ বিজয়চাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হয়েছিল অষ্টম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন । রাজকীয় সেই আয়োজনে সভাপতি ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং বিজয়চাঁদ রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন । অথচ কেন রবীন্দ্রনাথ এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না সে প্রশ্নের কোন উত্তর মেলে না । বরং সভাস্থল থেকে উঠে এসেছিল রবীন্দ্র বিরোধী কথা । যেমন বলা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন সত্য কিন্তু যাঁরা সেই পুরস্কার দিয়েছিলেন তাঁরা বাংলা সাহিত্য বোঝেন কতটুকু ? কবি সম্ভবত অভিমানাহত হন । ১৯২১ বঙ্গাব্দে বর্ধমানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল । দুর্ভিক্ষের সেই দুঃখ ছুঁয়ে গিয়েছিল যুবক রবীন্দ্রনাথকে । পরবর্তীকালে সে দুঃখের কথা তিনি লিখেছিলেন তাঁর লেখনীতে, ‘দিন মাস যায়, বরষ ফুরায় /ফুরাবে না হাহাকার? /ওই কারা চেয়ে শূন্য নয়ানে/ সুখ-আশা-হীন নববর্ষ-পানে ।’ পরবর্তীকালে বর্ধমানের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দেবপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়-এর উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয় । কবির বয়স তখন পঁচাত্তর । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্মাননার সেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ স্বয়ং । তাঁর ভাষণে তিনি ঠাকুর পরিবারের সুখ্যাতির কথা তুলে ধরেন । শরীর বিশেষ ভালো না থাকায় দীর্ঘ বক্তব্য তিনি রাখেননি । তবে বারেবারে সেদিন ফুটে উঠেছিল তাঁর নিজের আনন্দ ও খুশি । অনুষ্ঠান শেষে ট্রেনে চেপে কবি ফিরে যান তাঁর প্রাণের শান্তিনিকেতনে ।
মানিকচাঁদের নাম শুনেছেন ? বাংলার ইতিহাসে মানিকচাঁদ উপেক্ষিত ৷ বহু খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ প্রক্ষিপ্ত ভাবে মাণিকচাঁদ সম্পর্কে কিছু উক্তি করেছেন ৷ অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন, প্রাথমিকভাবে কুশলী পাঞ্জাবি ক্ষেত্রী (ভিন্ন মতে, তিনি বাঙালি) ও পরে দেওয়ান মাণিকচাঁদ ৷ বর্ধমান জেলার প্রাচীন জনপদ দাঁইহাটে ‘দেওয়ানগঞ্জ’ অঞ্চল ও তখনকার গঙ্গাতীরবর্তী ‘মানিকচাঁদের ঘাট’ আজও তাঁর সাক্ষ্য বহন করছে ৷ বর্ধমান শহরে বর্তমান বর্ধমান রাজবাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে, মানিকচাঁদের বিশাল ভগ্ন প্রাসাদ এবং কুলদেবতা রাধাকান্ত মন্দির আজও আছে ৷ তিনি ভাগ্যান্বেষণে এসে বর্ধমান মহারাজ কীর্তিচাঁদের সুনজরে পড়ে রাজকর্মে নিযুক্ত হন ৷ ধীরে ধীরে তাঁর দক্ষতা ও কর্মকুশলতার গুণে তিনি বর্ধমানরাজের দেওয়ান হন । ইনি পলাশির যুদ্ধে সিরাজের একজন অন্যতম সেনাপতি ছিলেন ৷ সিরাজও মানিকচাঁদের উপরে এতটাই নির্ভর করতেন যে, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন অবাধ্য ইংরেজদের হারিয়ে কলকাতা দখল করে তিনি মানিকচাঁদ-কে তাদের ভার দিয়ে মুর্শিদাবাদ ফিরে যান ৷ ইতিমধ্যে যখন মানিকচাঁদ শাসক হলেন , তিনি ডায়মন্ড হারবার রোডে, বেহালা অঞ্চলে একটি পরিখা-ঘেরা দুর্গের মতো বাগানবাড়িতে তাঁর শাসনকেন্দ্র তথা আবাস গড়লেন ৷ এই জায়গা বাছার অন্যতম কারণ ছিল, জলপথে শক্তিশালী ইংরেজদের গতিবিধি লক্ষ করা ও প্রয়োজনে তা নিয়ন্ত্রণ করা ৷ উল্লেখ্য, বিতর্কিত ‘অন্ধকূপ হত্যা’র সঙ্গেও মানিকচাঁদের নামও জড়িয়ে (যদিও তার সত্যতা নিয়ে সংশয় আছে) ৷
বর্ধমান শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের অনেক নির্দশন ও স্থাপত্য । একশো আট মন্দির থেকে যদি আপনি যাত্রা শুরু করেন তাহলে আপনার দ্রষ্টব্য তালিকায় থাকা উচিত, গোলাপবাগ, রাজবাড়ী, কৃষ্ণসায়র জলাশয় ও উদ্যান, পঞ্চমুন্ডী আসনে বসা সাধক কমলাকান্তের কালীবাড়ি, বিখ্যাত সোনার কালী, সাধক পীর খোক্কর সাহেবের মাজার, মোঘল বাদশা জাহাঙ্গীরের অমর প্রেম কাহিনীর করুন স্মৃতিবহনকারী শের আফগান ও কুতুবুদ্দিনের সমাধীস্হল, কাঞ্চন নগরে (যা একসময় ‘ছুড়ি-কাঁচির জন্য বিখ্যাত ছিল), বারোদুয়ারী, মা কংকালী অর্থাৎ কঙ্কালেশ্বরী, বর্ধমানেশ্বর, মা সর্বমঙ্গলার মন্দির, ঐতিহ্যবাহী নবাববাড়ি, কার্জন গেট (লর্ড কার্জনকে স্বাগত জানাতে যে অনিন্দ্য সুন্দর তোরণ তৈরি করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজ বিজয় চাঁদ) । সেই সঙ্গে বর্ধমানের সুখ দুঃখের নদ দামোদরের সৌন্দর্য তো আছেই । এই বর্ধমানের বুক চিরে চলে গেছে ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী শেরশাহের তৈরি গ্রান্ড ট্যাঙ্ক রোড । সত্যি ! ইতিহাস বর্ধমানের ছত্রে-ছত্রে বিরাজ করে । আর তাতেই সীলমোহর দেয় মাতৃস্বরূপা বর্ধমানের সন্তান-সৌভাগ্য, যা ইতিহাসের বর্ধমানকে সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান প্রদান করেছে ।
নাম : অভিষেক ঘোষ ।
ঠিকানা : ১৪২/এ, স্যুইন-হো লেন, কসবা, কোলকাতা – ৪২ ।