Wednesday, June 15, 2022

গল্প || নিরন্ন (পর্ব ১) || প্রীতম ঘোষ



নিরন্ন 

খন্ড - ১

                    দিনটা ছিল শনিবার , সকাল থেকেই পরিবেশ কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর হয়েছিল , আকাশের জমে থাকা মেঘ সূর্যকিরণ এর গলা টিপেধরে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছিল , পরিবেশ উত্তপ্ত যেন প্রেসার কুকার এর মধ্যে কেউ ঢুকিয়ে ঢাকনা এঁটে উত্তাপ দিচ্ছে ক্রমশ । অতীশ আজ আবার একযুগ পর অফিস যাচ্ছে , প্যানডেমিকে দেশ তথা রাজ্য হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়ায় এতদিন সেও বাড়ি বসে ইন্টারনেট মারফত কাজ করছিল । সে যাই হোক আবার অনেকদিন পর হারিয়ে যাওয়া স্রোতে সে ফিরতে পারবে এই ভেবে বেশ উৎসহের সাথেই তৈরি হচ্ছিল , সকালে উঠে স্নান সেরে ,পরিষ্কার ইস্ত্রি করা পোশাক পরে বেরোনোর তোড়জোড় করছিল ।এরপর সে খেতে বসে , এমন সময় হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলো ,খাওয়া ছেড়ে উঠে যেতেই তার মা পিছু ডাকলো - "খোকা এভাবে পাত ছেড়ে উঠে যেতে নেই ,অমঙ্গল হয় , মা লক্ষ্মী চঞ্চলা হন ! " , মায়ের কথায় কোনো কর্নপাত না করে অতীশ পাশের ঘরে রাখা ফোনটা রিসিভ করলো , কিন্তু ওপার থেকে আসা কথা গুলো শুনে তার পায়ের তলার মাটি যেন ফাঁক হয়ে গেলো । ফোনটা করেছিলন তার একজন সিনিয়র সহকর্মী , তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন - " আজ থেকে আর অফিস আসার প্রয়োজন নেই , তার বিগত বছরের পারফরমেন্স দেখে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে বরখাস্ত করা হবে , লকডাউনে কোম্পানি অনেক লস এ চলছে তাই কর্মী ছাঁটাই করা ছাড়া আর উপায় নেই ,তাই যাদের পারফরমেন্স খুব একটা ভালো ছিল না তাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে " । এই কথা শুনে হাজার কাকুতি মিনতি করে অতীশ কিন্তু ফল কিছুই হয় না , মুখের ওপর ফোনটা রেখে দেয় তার ওই সিনিয়র সহকর্মী। 

পাশে খাবার ঘরে ছেলের পুনরায় খেতে আসার অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে মা দেওয়ালে টাঙানো টিভিটা চালিয়ে দেখছিলেন , চালু হতেই খবরের চ্যানেলটি প্রথম চালু হয় কিন্তু অদ্ভুত ভাবে , টিভিতে নিউজ চ্যানেল দেখলেই বিরক্ত হয়ে ওঠা বাঙালি মা - কাকিমা - ঠাকুমা এর মত তিনি এবার কিন্তু বিরক্ত হলেন না বরং খবরে যেন মগ্ন হয়ে গেলেন । বিষন্ন বদনে অতীশ যখন সেই ঘরে এলো, তখন তাকে দেখেই বলে উঠলেন - "এসে গেছিস বাবা , নে এবার খেয়ে নে , সব যে ঠান্ডা হয়ে গেল , খাবার সময় ফোন ধরবি না বাপু !" , "দেখছিস বাবু খবরে কি দেখাচ্ছে , বলছে লকডাউনে কত লোকের বিনা কারণে চাকরি গেছে , আর যে কি কি দেখতে হবে এ জন্মে কে জানে , রক্ষে করো ঠাকুর রক্ষে করো " । অতীশ সে কথায় কর্নপাত করে না , তবে এবার তার মায়ের সন্দেহ হয় , ছেলের মুখ অবসন্ন হয়ে গেছে হটাৎ করে , খাবারেও হাত দিচ্ছে না , সকাল থেকে এত উৎফুল্য ছিল অফিস যাবে বলে আর হটাৎ কি এমন হলো ? মা কারণ জিজ্ঞেস করাতেই সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে উঠে গিয়ে এঁটো  হাত না ধুয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো সে । মা অপর দিকে চিৎকার করতে থাকেন - " কোথায় যাচ্ছিস ? খাবার ফেলে ? অফিস যাবি না ? কি হল ? এঁটো হাতে বেরোতে নেই খোকা ! " কিন্তু সেগুরে বালি ছেলে তখন এক ছুটে পাড়ার মোড়ে চঞ্চলের চায়ের দোকানে দাড়িয়ে । তার এই উদ্বিগ্ন অবস্থ দেখে চা ওয়ালা চঞ্চল প্রশ্ন করে - " কি হলো বস ? এরম অবস্থা হটাৎ কিছু ক্যাওড়া হয়েছে নাকি ? কি গো ! শুনছো নাকি ? " এসব না শুনে অতীশ তাকে বলল জল দিতে , জল নিয়ে হাত ধোয় সে ,এরপর খানিকটা জলে গলা ভিজিয়ে সে সেখানেই একটা বেঁচে মাথা হেঁট করে চুপ করে বসে থাকে । 

এরপর আগমন হয় দীপেন এর , দীপেন আর অতীশ ছোটবেলার বন্ধু , পাশের পাড়ায় থাকে , স্কুল ও কলেজে সে অতিশের সহপাঠী ছিল ফলে তাদের বন্ধুত্বের গাড়ত্ব অনেক বেশি , বিগত দুই বছর তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না , দুজনেই নিজ নিজ কাজে এত মগ্ন হয়ে যায় যে আজকালকের মুঠোফোনের যুগেও দুই হরিহর আত্মা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন । যাই হোক  অতীশ তাকেও যেন পাত্তা দিল না বিষন্ন বদনে মাথা নামিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় সে আচ্ছন্ন , চাকরি গেছে , হাতে যা জমানো পয়সা আছে তাতে মেরেকেটে কয়েক মাস চলবে , বাবার পেনশনের পয়সা আটক হয়ে আছে , পরিবার কে খাওয়াবে কি ? কোথায় যাবে ? কি করবে ? সব যেন তার মাথায় ঘুর্নিঝড় তুলছে , এরি মাঝে সে অনুভব করে হঠাৎ একটা হাত তার কাঁধে এসে তাকে ঝাকুনি দিচ্ছে , তাতে তার দুশ্চিন্তার দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে যায় কানে আসে - "ও অতীশ বাবু , কি খবর গো , বহুদিন হলো দেখা নাই - পাত্তা নাই , চিনতে পারছ তো ? কেমন আছো গো ? " এসব শুনে চমকে গিয়ে অতীশ জবাব দেয় - " কে ! কে !  অ তুই .. তা ভালো আছিস তো? কি করিস এখন? কাকু কাকিমা ভালো আছেন? কোথায় থাকিস এখন ? " এসব শুনে দীপেন বলে ওঠে - উরে ব্বাবা ! প্রশ্নের উত্তরে এত প্রশ্ন ? দাড়া ভাই  সবের উত্তর আছে একটু আসর জমিয়ে বসতে হবে দেখছি , আমি তোকে সামান্য কটা প্রশ্ন করলাম তার উত্তর তো পেলামই না  উল্টে তুই তো আমাকে প্রশ্নের পাহাড় ছুঁড়ে দিলি " , বলে একটা সিগারেট বের করে মুখে দেয় দীপেন , আর একটা বন্ধুর দিকে বাড়িয়ে দেয় , অতীশ সেটা ঠোঁটে গুঁজে আগুন খুঁজতে থাকলে , দীপেন গ্যাস লাইটার দিয়ে নিজেরটা জ্বালানোর সাথে সাথে বন্ধুরটাও ধরিয়ে দেয় । সিগারেট এ টান দিয়ে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করে অতীশ কিন্তু পারে না। 

ক্রমশ... (চলবে)


No comments:

Post a Comment