Wednesday, June 15, 2022

গল্প || সৌমি সেন



ত্যাগ

প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে শুভর কান রেলগাড়ির বাঁশির শব্দে সজাগ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এসে সে ট্রেনের দূরত্ব দেখতে চেষ্টা করল।ট্রেনটা প্রায় চলেই এসেছে, দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান আজ হতে চলেছে। শরীর এক অভূতপূর্ব আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠে,আর সেইসঙ্গে বুকে হৃদস্পন্দন আরও দ্রুতগতিতে ধাবিত হতে শুরু করে।যথারীতি ট্রেন এসে প্লাটফর্মে থামতেই মহিলা কামড়া থেকে বেড়িয়ে আসে একটি ওয়ান পিস পরিহিত খোলা চুলের সুন্দরী রমণী।এক হাতে তার হ্যান্ড ব্যাগ অপর হাতে ট্রলি ধরে রাখা।এদিকে ওদিকে সে তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজে চলেছে।শুভর মনে বারবার প্রশ্ন জাগে কে এই রমণী। তার বড়ো বড়ো চোখের চঞ্চল দৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়া শুভর মন যে কারণে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল সেটাই ভুলে যায়। হঠাৎ যাত্রীদের ধাক্কায় তার সম্ভিত ফিরতেই ,সে এগিয়ে যায়।মিস ঈশিতা আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন। হুমম, চঞ্চল দৃষ্টির বড়ো বড়ো চোখের মেয়েটি শুভর কথায় সামান্য উত্তর দেয় মাত্র।শুভ এগিয়ে গিয়ে ঈশিতার ব্যাগটা নিজে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ঈশিতা বলে , নিজের জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার আছে মিঃ শুভ।শুভ চমকে গিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হতভম্বের মতো প্রশ্ন করে বসে, আপনি আমার নাম.....।এতো ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই আমি আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি, কিন্তু এখন সেসব কথা বলবার সময় বা এনার্জি কোনোটাই আমার নেই। আপনি যদি আমাকে আমার গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছে দেন তো উপকৃত হই,আসলে অনেকবছর পর এলাম তো তাই সব কিছুই অচেনা মনে হচ্ছে হয়তো পরিবর্তিত হয়ে গেছে সবই; থাক সেসব কথা।শুভ ঈশিতার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। ঈশিতার ব্যাগগুলো একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে, ঈশিতাকে তার বাইকে ওঠতে বলায় সে জানিয়ে দেয় সে ওঠবে না।শুভর জোর করার কোনো অবকাশ না থাকায় ঈশিতাকে তার ব্যাগ সমেত একটা অন্য গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে নিজে গাড়ির পিছনে বাইক নিয়ে আসতে থাকে।শুভর মনে পরে যায় পাঁচ বছর আগের কথা,ঈশিতা তখন তার জীবনের সবটুকু অংশেই বসবাস করত আর আজকে.........। ঈশিতার বাড়ির কাছে এসে গাড়িটা দাঁড়াতেই ভিতর থেকে তার মা আর দিদি বেড়িয়ে আসে।মা ঈশিতাকে দেখেই কেঁদে ফেলেন আর দিদি তাকে জড়িয়ে ধরে।ঈশিতাও কুশল বিনিময় করে ঘরে চলে যায় ফ্রেশ হতে। খাবার টেবিলে দুপুরের খাবার খেতে বসে সবাই ঈশিতাকে নিয়ে ব্যস্ত এমন সময় মায়ের মনে পরে শুভ তো এখনও বাড়ি ফেরে নি। ঈশিতার দিভাইকে প্রশ্ন করে ,শুভ কোথায়? ঈশিতা বেশ বুঝতে পারে শুভর না আসার কারণটা সে নিজেই , কিন্তু এতে তার কিছু করার নেই।বাড়ি সে কিছুতেই আসতে চাই নি, বাবার অসুস্থতার জন্য বারবার বলতে সে এসেছে তাও দুইদিনের ছুটি নিয়ে। খাবার শেষ করে ঈশিতা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঘরে চলে আসে।ঘরে এসে বহুদিনের ধুলো পড়া ডায়েরির পাতা খুলে বসে।এই পাতায় কত স্মৃতি জমে আছে,শুকনো গোলাপ, চুলের ফিতে, ট্রেনের টিকিট,ভাঙা চুরির ছোট্ট একটা টুকরো,চকলেটের খালি প্যাকেট।কত বোকা বোকা কাজ সে করেছে ,তার সাক্ষী এই ডায়েরীটা।আজ এটা খুলে পাতার পর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে শুধুই নিজের ওপর হাসি পায়।এমন সময় ঘরের দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে দিভাই।ডায়েরিটা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ,ওঠে বসে ঈশিতা। কিছু বলবি দিভাই।তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো জায়গা আমার নেই ঈশু ,আমি অনেক বড়ো অন্যায় করেছি তোর সাথে। ঈশিতা মৃদু হেসে বলে,আরে কিসব বলছিস তুই দিভাই।বলছি কি সেই নিরুকাকার ঝালমুড়ির দোকানটা এখনও আছে রে তাহলে আজ বিকালে তুই আর আমি যাব কেমন।বিনীতা ঈশুকে ধাক্কা দিয়ে বলে, আমার কথাটা তোকে শুনতেই হবে এভাবে আমাকে অপরাধী করে রেখে আমার কথা না শুনে তুই আমাকে এড়িয়ে যেতে পারিস না। ঈশিতা শীতল দৃষ্টি রেখে বলে,কি শুনব বল? তুই শুভকে ভালোবাসতিস সেজন্য পাঁচবছর আগে নিজের বিয়ের পনেরদিন আগে বাড়িতে বলেছিলিস শুভ তোর সাথে প্রতারণা করেছে আর তুই ওর সন্তানের মা হতে চলেছিস, এই তো। বিনীতা অবাক হয়ে বলে,তুই এসব জান.....।হুমম ,সব জানি আমি কিন্তু কিছু বলি না। যাইহোক ওসব কথায় আমি কিছু মনে করি নি,তোরা ভালো থাকলেই ভালো।আর মাকে বলে দিস আগামীকাল আমি ফিরে যাচ্ছি।দুদিনের ছুটিতে এসেছিলাম, কিন্তু এমার্জেন্সি পরে গেছে তাই ফিরতেই হবে।এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না,অনেকটা জার্নিং করেছি তো শরীরের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। বিনীতা আর বসে না থেকে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে গেল। ঈশিতার কানে বারবার বাজতে থাকলে তারই বলা কথাটি শরীরের বিশ্রামের প্রয়োজন ....... আর প্রশ্ন জাগল মনের বিশ্রাম? সে তো আর কম ধকল সহ্য করছে না,পাঁচ পাঁচটা বছর.......,আরো কত......।



Vill- Dhatrigram
Dist- Purbo Bardhaman


No comments:

Post a Comment