Thursday, March 17, 2022

গল্প || জয়ন্ত কুমার মল্লিক




মোট একটা

 
কিগো অমিত আজ কি দেরিতে অফিসে যাবে ? শোনো, তুমি আজ ট্যাক্সি বা ক্যাব করে অফিসে যেও। গতকাল বাসে করে আস্তে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে। কি বলছ মিতা ? উবের বা ট্যাক্সি করে যেতে কত খরচ হবে জানো ? বাসেই যাব- - এত একদিনের ব্যাপার নয় ।

 অমিত, তুমি না নিজের বিষয়ে কোনদিন সিরিয়াস হলেনা। আজ শুক্রবার তোমার অফিস এ সপ্তাহের শেষ দিন। কাল শনিবার একটা ছুটির দিন, রবিবারও ছুটি। আজ একটু আরামে যাওনা। আমাদের জন্য তো সব সময় গাড়ির ব্যবস্থা করো।

 না না ও কথা বোলনা মিতা। আমি ঠিক আছি। অত বিলাসিতা আমার মানায় না। অফিসের বড়বাবু দের দু-একজন ডেইলি বাসে যাতায়াত করে। তাছাড়া আমাদের অত আরাম পোষাবে কেন ? ভয় হয় বাসের মধ্যে ভিড়কে, , পথে-ঘাটে মিছিলের ঝামেলায় বাসের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা নয়তো ট্র্যাফিক জ্যাম কিংবা দুটি বাসের রেষারেষি আর রাস্তায় এখন সিগনালে বাস দাঁড়িয়ে পড়ে। এছাড়া বাসে অত ভিড়ের মধ্যেও ঝগড়াঝাঁটি লেগেই আছে উফ্ মাথা গরম হয়ে যায়। একেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়, ঠিকমতো নিঃশ্বাস নেওয়া যায়না তার পর যথেচ্ছ চিৎকার চেঁচামেচি হইচই কলহ। দূর ভালই লাগেনা।

-তাই বলছিলাম অমিত অন্তত একটা দিনের জন্য আমার কথা শুনে গাড়িতে যাও- একটু আরাম পাবে। ওবেলা আবার আমাদের নিমন্ত্রণ আছে। অফিস ফিরে ততটা বিশ্রাম পাবেনা। আর নিমন্ত্রণ বাড়ি তো খুব কাছে নয়।


 ঠিক আছে দেখছি, বলে অমিত খাওয়া-দাওয়া সেরে অফিসের ব্যাগে টিফিনবাক্স ছাতা জলের বোতল ভরে মেয়ে ছোট্ট টুসিকে আদর করে অফিসে যাওয়ার জন্য পথে বেরিয়ে পড়ে । সঙ্গে রুমাল আর অতি প্রয়োজনীয় মোবাইলটাও রাখে। পথে বেরিয়ে ফাঁকা ট্যাক্সি দেখে অমিতের মনটা একটু আনচান করলেও ইচ্ছা মনোগত অনুশাসনের কাছে হার মানে। শেষমেষ বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। স্ত্রীকে একটা কিছু বলে দেবে। না, ও অনেক রিকোয়েস্ট করেছে আরামে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ১০-১২ টাকার বদলে এক পিঠে আড়াইশো তিনশো টাকা খরচা করার কোনো মানে হয়না। এটা অভ্যাসে পরিণত হলেও খারাপ হবে। বাসে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না।

 এরপর এসব আর না ভেবে অমিত অফিস টাইমের ভিড় বাসে উঠে পড়ে । না, বাসে তো বাদুড়ঝোলা ভিড় নেই। বাসে উঠে সে সিনিয়র সিটিজেনদের বরাদ্দ সিটের সামনে হাতল ধরে দাঁড়ায়। অমিত ভালোরকম জানে যে এই সময়ে কে কতদূর যাবে, সামনের কোনো সিট ফাঁকাহবে কিনা জিজ্ঞেস করে কোন লাভ নেই। বৃথা কাউকে তার গন্তব্য স্থল এর কথা জিজ্ঞেস না করে অমিত এক বৃদ্ধ লোকের সামনে শান্তিতে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই ভিড়ের মধ্যেই অনেক যাত্রীর ফোন বেজে ওঠে। অমিতের ফোনও সরব হয়। অমিতের এক অফিস কলিগের ফোন। সে আজ অফিস যাবে না জানাচ্ছে। মোবাইলে বহু জন বহু রকম কথাবার্তা বলছে। কোন যাত্রী মাঝেরহাট থেকে অপর দিকে থাকা মোবাইল ধারক কে বলছে প্রায় পৌঁছে গেছি এই মেয়ো রোড পার হচ্ছি। কেউবা ফোনে কোন আত্মীয়কে এখন হাসপাতালেভর্তি তার বাবার অবস্থার কথা জানাচ্ছে। কোন প্রেমিক মৃদুস্বরে তার প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম আলাপে ব্যস্ত। এরই মধ্যে একটি লেডিস সিট ফাঁকা হলে এবং তার দাবিদার দুজন হওয়ায় বাসের মধ্যে যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কেউ থামাতে সাহস পায় না। একজন যাত্রী স্পর্ধা দেখিয়ে বলল- ম্যাডাম আপনি আপনার থেকে বয়স্ক মহিলাকে সিটটা ছেড়ে দিন। কিন্তু কে কার কথা শোনে ? ঠাকুরের কৃপায় এই কলরব থামতেই ভিড় বাসে এক যাত্রী বাসে উঠে আরেকজনের পা সজোরে মাড়িয়ে দিয়েছে।'সরি; শোনার সঙ্গে সঙ্গে আঘাত প্রাপ্ত ভদ্রলোক একেবারে ক্ষেপে উঠলেন। তিনি বলেন সরি কথাটা শুনে শুনে পচে গেল। একজন মধ্যবয়সী বলে উঠল- দাদা ওকে ক্ষমা করে দিন। ইচ্ছে করে তো করেনি। কিছুক্ষণ চলল তর্ক বিতর্ক বাক বিতণ্ডা। তারপর এ যাত্রায় পৃথিবী শান্ত হলো, কিন্তু এই শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। দাঁড়ানো এক যাত্রীকে কেউ পেছন থেকে ধাক্কা মারায় তিনি বলে উঠলেন- মশাই বাসে কী প্রথম উঠেছেন ? প্রত্যুত্তরে অনিচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেওয়া মানুষটি বললেন- ভিড় বাসে একটু আধটু গায়ে গা তো লাগবেই। তা বলে গায়ে গা লাগিয়ে ঝগড়া করবেন ? আপনি তো মশাই গাড়িতে করে যেতে পারেন। গায়ে আঁচ আঁচর কিছুই পড়বে না। এর মধ্যেই ভিড়ের চাপে গলদঘর্ম অমিত তার হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে নিল। বাসটা মন্দ যাচ্ছে না, যদিও ভেতরের অবস্থা খারাপ। এর মধ্যেই গরমে ভিড়ে একটা বাচ্চা কান্না ধরল, কিছুতেই আর থামতে চায় না। অমিত মাথাটা নীচু করে জানলা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল পৌঁছতে আর কতটা পথ বাকি ? হঠাৎই ডান দিকের ডবল সিটে জানলার পাশে বসা কিশোরটি বমি করতে শুরু করল। ওর বাবার কথায় কেউ একজন নিজের জলের বোতলটা ওদের দিয়ে দিল। এমনিভাবেই প্রায় এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে অমিত বাস থেকে নামল। নামাও দুষ্কর। গেটের মুখে যা ভীড়।নেমেই মানিব্যাগ আর মোবাইলটা দেখে নিল অমিত। যাক সব ঠিকঠাক আছে। ভীড় বাস পকেটমারদের রোজগারের নিরাপদ আশ্রয়। অফিসে পৌঁছে মুখ হাত-পা ভালোভাবে ধুয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে অমিত নিজ সিটে বসলো। স্ত্রীকে ফোন করে শুধুমাত্র পৌঁছানো সংবাদ দিল। অন্যকিছু আর বলল না। পাশে বসা সহকর্মীকে খুব সংক্ষেপে ওর বাস জার্নির বিবরণ দিয়ে বলল- দাদা এবার আর বাসে যাতায়াত করা যাবেনা। পাশে বসা সহকর্মী জবাব দিলেন- ঠিকই কথা ভাই কিন্তু আমাদের উপায় নেই। মাঝেমধ্যেই বাস ভাড়া বাড়ছে, ভাড়া না বাড়লে বাস ধর্মঘট অথচ যাত্রী স্বাচ্ছন্দ নেই।

 এরপর কাজের মধ্যে ডুবে যায় অমিত। অফিসের বসকে বলে একটু আগে আজ বেরোনোর ইচ্ছে কারণ সন্ধ্যায় নিমন্ত্রণ আছে। মিতা অপেক্ষা করে থাকে। একবার ভাবে আজ বিকালে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরবে। মন সায় দেয়। এরপর অফিস থেকে বেরিয়ে সামনে একেবারে ফাঁকা বাস দেখে। এই বাস অমুক জায়গায় যাবে ভাই ? কন্ডাক্টর হ্যাঁ বলায় অমিত তড়িঘড়ি উঠে পড়ে। এতো ফাঁকা বাস কল্পনা করতে পারে না অমিত। এই সময়ে বাস এতো খালি কেন ? হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি লোক। এই নম্বর রুটের বাস তার কোনদিন চোখে পড়েনি । যাক এ নিয়ে মাথা ঘামায় না অমিত । বাড়ী পৌছলেই হল।

বাসের ভিতর ঝগড়া ঝামেলা নেই কোলাহল নেই। অমিত স্ত্রী মিতাকে জানায়- বাসে যাচ্ছি। বাসের ভিতর যেন গড়ের মাঠ। একদম ফাঁকা তাই তোমার কথামত তোমার কথামতো ট্যাক্সি বা উবের ধরলাম না । প্রায় এক ঘণ্টার পথ ।যাত্রীরা ওঠানামা করে চলেছে। ওফ সারাটা জীবনে যদি এরকম বাস পাওয়া যায় ভাবে অমিত। 

        তারাতলা পেরোবার পরই হঠাৎ কন্ডাক্টরের সঙ্গে এক যাত্রীর তুমুল ঝগড়া শুরু হয়।তাই ড্রাইভার বাসটি বাম পাশ করে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল। অমিতের নেমে যাওয়ার স্টপেজ প্রায় এসে যাওয়াতে অমিত সামনে এগিয়ে গেল। ওই যাত্রীকে জিজ্ঞেস করল- দাদা, ব্যাপারটা কি, কি এমন হলো? 

 ওই যাত্রীটি উত্তর করলো- দাদা এই কন্ডাক্টর কোন দিন স্কুলে যায়নি। ওকে এই রুটে কটা বাস জিজ্ঞেস করায় ও বলল- মোট একটা। আচ্ছা দাদা- একটা হলে বা একটার আগে কি মোট শব্দটা বসে ? 

 ও এই ব্যাপার। যাহোক দুজনকে শান্ত করে অমিত ড্রাইভারকে ইঙ্গিত দিতেই বাস চালু হলো। অমিতের এবার বাস থেকে নেমে পড়ার পালা। অবশ্য মোট একটা বাস কথাটা শুনে অমিত মনে মনে খুব হেসেছে।


জয়ন্ত কুমার মল্লিক
৬৭৩এ, ডায়মণ্ড হারবার রোড
বেহালা, কলকাতা-৭০০০৩৪


No comments:

Post a Comment