ঠুনকো
মেমারিতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে বেশ ঘটা করে সারাদিন ব্যাপী রক্তদান শিবির চলছে।সবার মতো দুলালও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সেও রক্ত দান করবে।শিবির চত্বরে আর্ট পেপারে লাল রঙে লেখা- রক্তদান জীবন দান, আসুন রক্ত দিয়া প্রাণ বাঁচায়,একের রক্তে অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন ইত্যাদি।
দুলাল লেখাগুলো পড়তে পড়তে লাইন বরাবর এগোতে লাগলো। ভিড় মোটামুটি ভালই।তবে ঠেলাঠেলি নেই। রক্তদানের আগে হেলথ চেক আপ হয়। দুলাল এগোতে এগোতে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।এবার ওর প্রেশার মাপা হবে।ওজন হবে।আসলাম ফোন করেছে সেই মুহূর্তে।হেলথ চেক আপ শুরু হওয়ায় ফোনটা কেটে দিল দুলাল।
আসলাম দুলালের বন্ধু। সে একটু ভাবুক প্রকৃতির ছেলে।অল্প ভাবনাতেই ওর শরীর থেকে মন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। চিন্তিত আসলাম মনে মনে বলল, কেটে দিল কেন? রাগ করল নাকি? আসলে দুজনেরই রক্তদান শিবিরে আসার কথা থাকলেও আসলাম শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছে করে আসে নি। আশ্চর্য, বেআক্কেলে দুলাল জানতেও চায় নি কি হয়েছে ওর।
আসলামের সঙ্গে ওর কলেজ জীবন থেকে বন্ধুত্ব।দিন যত এগিয়েছে, ততই উন্নত হয়েছে ওদের সম্পর্ক।প্রতিবছর বাইকে চেপে ঘুরতে যায়।একসঙ্গে ব্যবসাও করে। একে অপরের বিপদে শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ে বললে ভুল হবে, বলা উচিত দুলালের বিপদকে আসলাম নিজের বিপদ মনে করে। দুলালের দুঃখ, অপমানকে সে নিজের দুঃখ, অপমান ভেবে জবাব দিতে পিছ পা হয় না।রোজ কথা না হলেও দু একদিন গ্যাপ হলে মনটা কেমন যেন লিসপিস করে।আসলাম ভালবেসে দুলালকে “অক্সিজেন” বলে ডাকে।তবু মাঝে মাঝে দুলালের প্রতি তার অভিমান হয়। এই যেমন দুলালের বাড়িতে লক্ষ্মী পুজোয় আসলাম ডাক না পেলে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে।তবে দুলাল প্রতিবার ইদে ডাক পায়।একবার আসলাম ধৈর্যচ্যুত হয়ে বলেই ফেলল, কি রে একা একাই প্রসাদ খেলি? কই ডাকলি না তো?
দুলাল বলেছিল, আরে বিশেষ কিছু আয়োজন ছিল না। জাস্ট ঘরোয়া আয়োজন। মা বলেছিল তোকে ডাকতে। কিন্তু আমিই বললাম রাত হয়ে যাবে, কে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবে অতো রাতে। তাই আর ডাকি নি তোকে।
আসলাম ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোয় নি।ঠোঁট চেপে হাসার চেষ্টা করেছিল। আসলাম তো বেশি কিছু চায় নি। চেয়েছিল বন্ধুর পরিবারের সদশ্য হতে। কিন্তু জন্মদিন হোক কিংবা পুজো, দুলাল কোনদিন আসলামকে ডাকে নি। আসলাম যখনই প্রশ্ন তুলেছে “কই আমায় ডাকলি না তো”? প্রতিবার জবাব পেয়েছে, “বিশেষ কিছু হয়নি। ঘরোয়া ছোটো করেই আয়োজন হয়েছিল। তাছাড়া…”। কিছুটা থেমে বলল, “তাছাড়া কাউকেই ডাকি নি”।
আসলাম কেবল মনে মনে বলেছিল “কেউ আর আমি এক”! কোন কালেই আসলামের মনের কথা বোঝেনি। এখনও বুঝলো না। দুলাল বলেই চলল, “পরের বার বড় করে করবো। তখন সবাইকে ডাকবো”।
দুলালের জন্মদিনে আসলাম শুধুই ফোনে শুভেচ্ছাটুকু পাঠায়। এর বাইরে ঘটা করে জন্মদিন উদযাপনের সুযোগ সে পায় না। দুলালের মা, বাবা, বোন বাড়িতে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে কিন্তু আসলাম নামে তার পাতানো ভাইটা কেবল অপেক্ষাতেই থাকে। অপেক্ষা… আরও অপেক্ষা ……তারপর উপেক্ষা … এরপর শুধুই উপেক্ষা।আত্মার সম্পর্কের একটাই আক্ষেপ সে কোনদিন রক্তের সম্পর্ক হতে পারে না।
বেডে শুয়ে আছে দুলাল। সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে একটা নির্দিষ্ট ব্যাগে জমা হচ্ছে।কিছুক্ষণ পর দুলাল উঠে বসলো। মাথাটা সামান্য ঘুরছে।নির্দিষ্ট ব্যাগে জমা রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ভাবল, আমার এই রক্ত কারোর শরীরে যাবে ঠিকই কিন্তু সে কোন দিনই আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ হবে না।কি আজব বিচার!
ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাতে একটা হরলিক্সের গ্লাস ধরিয়ে চলে গেলো ভলেন্টিয়ার। দুলাল তাতে চুমুক দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসলো। রক্তদাতাদের জন্য এখানে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।গ্লাসে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে ভ্রু তুলে তাকাল দূরে। ব্যানারে লেখা- একের রক্তে অন্যের জীবন। রক্তই হোক আত্মার বাঁধন।
ফোনটা বেজে উঠেছে। পকেট থেকে বের করে হাতে নিয়ে দুলাল দেখল আসলামের ফোন। রিসিভ করতেই আসলাম বলল, রক্ত দিলি? ঠিক আছিস?
হ্যাঁ।আর তুই? শরীর ভালো হল?
না, বুকের কাছে ব্যাথা ব্যাথা করছে।
- কেন? _
- জানি না-
আসলাম আর কথা বাড়াল না। “সাবধানে আসিস” বলে ফোনটা রেখে দিল।
দুলালেরও মন খারাপ। মন খুলে কথা না বললে তারও ভালো লাগে না। গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিয়ে কনুইয়ের ভাঁজ থেকে তুলোটা সরিয়ে দেখল রক্ত বের হয়নি।কিন্তু দুলাল জানে সম্পর্কের শরীরে রক্ত ক্ষরণ অব্যাহত।রক্তের রঙ একই কিন্তু গ্রুপ আলাদা। একই ব্লাড ব্যাঙ্কে একসাথে থাকলেও নির্দ্বিধায় রক্ত এভাবেই রক্তের থেকে আলাদা হয়ে যায়।
মেমারী, পূর্ব বর্ধমান
No comments:
Post a Comment